আমিনুল ইসলাম মল্লিক
২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫৫ পিএম
একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বিচার বিভাগ। মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ ঠিকানা আদালত। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ থাকলেও দিন শেষে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় সবাইকে। যারা অভিযোগ তোলেন তাদেরও আদালতকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। একটি মামলায় সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বিচারকের আছে। রায়ে কেউ ক্ষুব্ধ হলে যথাযথ ফোরামে পুনর্বিচার চাওয়ার সুযোগও রয়েছে।
কিন্তু যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করে রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বিচারককের সঙ্গে সরাসরি অসৌজন্যমূলক আচরণ কিংবা তাকে আঘাত একটি ন্যাক্কারজনক কাজ। এটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর দ্বারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি দুর্বল হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তারা।
সম্প্রতি দেশের দুটি আদালত প্রাঙ্গণে বিচার চলাকালে অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে বিচারককে আসামি এবং পঞ্চগড় আদালতে বিচারককে বাদীর জুতা নিক্ষেপের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা দুটি কিসের ইঙ্গিত সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। এটা কি বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থার কারণে না কি অন্য কিছুর জন্য সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ বলছেন, এটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তবে কেউ কেউ বলছেন, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থার কারণেই এমনটা ঘটছে। মানবাধিকার কর্মীরা বিচারকদের আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারকাজ পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আদালতে বোমা হামলা হচ্ছে, বিচারকের পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেন এত বিশৃঙ্খলা হচ্ছে? ঢাকা কোর্টে বোমা হামলা, বিচারকের পদত্যাগ চাওয়া— এগুলো ক্রমাগত হচ্ছে।
আপিল বিভাগের জেষ্ঠ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, জামিন দিলেও সমালোচনা, না দিলেও সমালোচনা। কিন্তু কেন? বিচারক তার কাজটি করবেন এটাই স্বাভাবিক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটকে জুতা দিয়ে ঢিল মেরে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। কোনো আসামিকে জামিন দেওয়া না দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার। এটা তার বিচারিক স্বাধীনতা। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে কেউ ক্ষুব্ধ হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে যথাযথ ফোরামে যাওয়ার সুযোগ আছে। ক্ষুব্ধ ব্যক্তি দায়রা আদালতে আপিল করতে পারত। কিন্তু তা না করে বিচারককে ঢিল মেরে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ করেছে। জঘন্য অপরাধ করেছেন মামলার বাদী।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘এমন ঘটনায় ঢিল ছোড়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন ম্যাজিস্ট্রেট। ওই ব্যক্তিকে ছয় মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।’
তবে এমন ঘটনা বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থার শামিল উল্লেখ করেন হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘বিচারককে জুতা দিয়ে ঢিল দেওয়া স্বাধীন বিচার বিভাগের মানুষের আস্থা উঠে যাওয়ার চিত্র। আজ থেকে বিশ বছর আগে এরকম ঘটনা আদালতে দেখা যায়নি। দিন দিন এ রকম ঘটনা বাড়ছে। এর দায়-দায়িত্ব বিচারকদেরই নিতে হবে। বিচারটা করতে হবে এমনভাবে যাতে সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি হয়।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জামিন দিতে পারেন। সেই ক্ষমতা তার আছে। তবে দেখতে হবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলো কী না।’
গত ১১ ডিসেম্বর পঞ্চগড় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলার আসামিদের জামিন মঞ্জুর করায় ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারককে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন মামলার বাদী। পরে অভিযুক্ত মিনারা আক্তার (২৫) নামের ওই নারীকে আটক করে পুলিশ।
আইনজীবী ও বাদীর স্বজনরা জানান, গত ৫ ডিসেম্বর পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ছোট ভাই আব্দুল মমিনের (৬৫) কিলঘুষিতে বড় ভাই ইয়াকুব আলী (৮৩) মারা যান। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই নিহত ইয়াকুব আলীর মেয়ে মিনারা আক্তার বাদী হয়ে পঞ্চগড় সদর থানায় ১৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পঞ্চগড়-১ এ ১৯ জন আসামির মধ্যে ১৬ জনকে আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন।
শুনানি শেষে সব আসামিকে অন্তবর্তীকালীন জামিনের আদেশ দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাদী। এ ঘটনায় আদালতে হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় বাদী মিনারা আক্তার ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারককে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন। তাৎক্ষণিক পুলিশ আদালত থেকে মিনারা বেগমকে আটক করে হেফাজতে নেন। পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠলে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।
এদিকে চট্টগ্রামের আদালতে এক বিচারককে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মারেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার এক আসামি। গত ২৮ নভেম্বর বেলা ১২টার দিকে চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইবুনাল আদালতের এজলাসে এ ঘটনা ঘটে।
আদালতে জামিন শুনানির সময় আসামি মনির খান মাইকেলের (৩২) বিচারকার্য শুরু হলে বিচারককে লক্ষ্য করে পরপর দুটি জুতা নিক্ষেপ করেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ তাকে নিবৃত্ত করে। এর আগে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে আদালতে আনা হয়।
আদালতের তথ্যমতে, জাতির জনক ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগে ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানায় পুলিশ উপ-পরিদর্শক তপু সাহা বাদী হয়ে আসামি মনির খান মাইকেলের (৩২) বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন। পরদিন ২৩ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২০ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
এআইএম/জেবি