মাহফুজ উল্লাহ হিমু
২০ আগস্ট ২০২২, ০৬:৫৮ এএম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীন চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম সেন্টারভিত্তিক সুপার স্পেশাইলাইজড হাসপাতাল। ৭৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে থাকছে সবধরনের আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। দেশের রোগীদের বিদেশমুখিতা বন্ধ ও জনগণকে সর্বাধুনিক সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে হাসপাতালটি চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণসহ হাসপাতালের ৯৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসেই (সেপ্টেম্বর) হাসপাতালটি উদ্বোধনের প্রস্তুতি রয়েছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের।
কাজের অগ্রগতির বিষয়ে হাসপাতালটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জুলফিকার রহমান খান জানান, ইতোমধ্যে ভবনের স্ট্রাকচারাল, আর্কিটেকচারাল ও সিভিল ওয়ার্কের কাজ প্রায় শেষ। এছাড়া মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল, ইনফরমেশন সিস্টেমসহ (এইচআইএস) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ কাজ চলছে। হাসপাতালটির যাবতীয় কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এদিকে হাসপাতালটির উদ্বোধনী দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিম বু-কিয়ামের সশরীরে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
আরও পড়ুন: হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদয়হীন কারবার!
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ছিল এই দেশেই যেন সব রোগীর চিকিৎসা করা যায়। চিকিৎসার জন্য যেন হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে না যায়। সেই লক্ষ্যেই আমরা এই হাসপাতালের কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য দেশের মানুষ যেন সর্বোত্তম সেবা পায়। কাউকে যেন বাইরে যেতে না হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন সুস্থ মানুষ। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার দেশে নিশ্চিত করতে আমাদের এ উদ্যোগ। এটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি।’

এটিকে সুপার স্পেশালাইজড কেন বলা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালে ৭৫০টি শয্যা থাকবে। এখানে সব ধরনের জরুরি রোগীদের দ্রুততম সময়ে সেবা দেওয়া হবে। জরুরি বিভাগেই অপারেশন থিয়েটার থাকবে। রোগীর অবস্থা নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান, এমআরআইসহ সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা জরুরি বিভাগেই থাকবে। আমাদের এখানে ভিআইপি, ভিভিআইপি, ডিলাক্স কেবিনসহ ৫৪০টি শয্যা থাকবে। আর ১০০টি জরুরি বেড থাকবে। পাশাপাশি মোট ১০০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) শয্যা থাকবে। এর মধ্যেই এনআইসিইউ, পিআইসিইউ এবং মেডিকেল সার্জিকেল আইসিইউ থাকবে।’
আরও পড়ুন: রোগীতে ঠাসা পঙ্গু হাসপাতাল, আর্তনাদে ভারী পরিবেশ
‘এই হাসপাতালে মূলত লিভার ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টসহ যেসব কারণে দেশের রোগীরা বাইরে যায়, সেসব খাতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। যেমন: ক্যানসার, ইনফার্টিলিটি, কার্ডিয়াক সার্জারি, স্ট্রোক ইত্যাদি চিকিৎসায় মানুষ সবথেকে বেশি বাইরে যায়। এসব সমস্যার সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের এখানে থাকবে। আমরা ভবিষ্যতে সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি যে চিকিৎসা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইউরোপ-আমেরিকাতে গিয়ে করতে হয় তা দেশেই করবো। যেমন রোবটিক সার্জারি, এটা আমরা এখানে করবো। এছাড়াও ন্যানো পার্টিকেল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করতে চাই। বিএসএমএমইউ বর্তমানে আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআরের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণা নিয়ে অনেকগুলো পরিকল্পনা আছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই হাসপাতাল তা আরও তরান্বিত করবে’, যোগ করেন অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ।
সর্বোচ্চ সেবার মান নিশ্চিত করা হবে
সেবার মানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘আমরা চাই না এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেউ বলুক, ‘এখানকার কেবিন বা পরিবেশ ভালো না। আমি সিঙ্গাপুর বা স্কয়ারে যাবো।’আমরা এখানেই সবধরনের সেবা দিতে চাই। কেউ কেউ বলে, বিদেশে তো সব চিকিৎসক সারাদিনই হাসপাতালে থাকে। আমাদের এখানে কী হবে? এ অবস্থায় আমরা ভবিষ্যতে ওপিডি চালাবো। ওপিডি বলতে বোঝায়, বিশেষজ্ঞরা বিকেলে এখানেই প্র্যাকটিস করবেন। অর্থাৎ ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস। একই চেম্বারে দুই ঘণ্টা করে তিনজন চিকিৎসক একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন। এ দেশের অনেক খ্যাতিমান চিকিৎসক আছেন। তারা যদি অন্তত একদিন করেও এখানে সেবা দেন, তাহলে অনেক রোগীকে আমরা সেবা দিতে পারবো।’

চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যের মধ্যে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার খরচ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা তাদের বলতে চাই, এখানে ইউনাইটেড, স্কয়ার, এভারকেয়ারের মতো খরচ লাগবে না। তবে যেহেতু ওই স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা সেবা দিতে হবে, তাই সেবা কেনার জন্য জেনারেল হাসপাতাল থেকে কিছুটা বেশি ব্যয় হবে। কিন্তু তা করপোরেট হাসপাতালের মতো এত বেশি নয়। এক্ষেত্রে কেবিন, ওটি চার্জের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা বেশি লগতে পারে। তবে তা মানুষের সক্ষমতার মধ্যে থাকে তা লক্ষ্য রাখা হবে। এ জন্য ধনী লোকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি মনে করি এই হাসপাতালের মাধ্যমে সবার উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’
স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের বিষয়ে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখানে কোয়ালিফাইড ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবো। যেমন এই হাসাপাতালের আউটডোরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখবেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা অভিজ্ঞদের নিয়োগ দেবো। নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষ্য রাখা হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। আমাদের এখানে আগামী দুই বছর কোরিয়ার বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স থাকবেন। তারা রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। আমরা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে এ কাজ পরিচালনা করবো।’
যেভাবে যাত্রা শুরু
২০০৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে ২০১২ সালে হাসপাতাল সংলগ্ন প্রায় ১২ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জনগণের জন্য বিশেষায়িত সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপনের প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করা হয়। পরে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ইডিসিএফের ঋণ সহযোগিতার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে মোট এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। আর বাকি ৩০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের। দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণটি ৪০ বছর মেয়াদি। তবে এর প্রথম ১৫ বছর কোনো টাকা পরিশোধ করতে হবে না। তারপর থেকে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ সুদে এই ঋণ শোধ দেওয়া শুরু করবে সরকার।
অবকাঠামো ও সক্ষমতা
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটির কার্যক্রম চলবে ছয়টি বিশেষায়িত সেন্টারের মাধ্যমে। কার্যক্রম চালু হলে এসব সেন্টারে দুই বছরের জন্য নিয়োজিত থাকবেন ছয়জন কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ও ৫০ জন কোরিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এদেশীয় জনবলকে প্রশিক্ষিত করতে তারা ভূমিকা রাখবেন। এছাড়া সেবাখাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা দেশীয় জনশক্তিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে এই হাসপাতালে নিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন: ঢাকামুখী রোগীর স্রোত ঠেকাতে মেডিকেল কলেজগুলো কতটা সফল
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অর্থায়নে হাসপাতালটির দুটি বেসমেন্টসহ ১৩ তলা ভবনে থাকবে বিশ্বমানের সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে থাকবে ১৪টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার আইসিইউ, জরুরি বিভাগে থাকবে ১০০টি শয্যা। এছাড়া ছয়টি ভিভিআইপি কেবিন, ২২টি ভিআইপি কেবিন এবং ডিলাক্স শয্যা থাকবে ২৫টি। সেন্টারভিত্তিক প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবে আটটি করে শয্যা। সেবার গুণগতমান বজায় রাখতে হাসপাতালটির আসবাবপত্র ও সরঞ্জামগুলো দক্ষিণ কুরিয়া থেকে আনা হয়েছে।
যে ধরনের সেবা পাওয়া যাবে
নবনির্মিত হাসপাতাল ভবনের প্রথম পর্যায়ে থাকবে- স্পেশালাইজড অটিজম সেন্টারসহ মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ কেয়ার সেন্টার, ইমার্জেন্সি মেডিকেল কেয়ার সেন্টার, হেপাটোবিলিয়ারি ও গ্যাস্ট্রোঅ্যান্টারোলজি সেন্টার, কার্ডিও ও সেরিব্রো ভাস্কুলার সেন্টার এবং কিডনি সেন্টার। দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকবে- রেসপিরেটরি মেডিসিন সেন্টার, জেনারেল সার্জারি সেন্টার, অপথালমোলজি, ডেন্টিস্ট্রি, ডার্মাটোলজি সেন্টার এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার।

হাসপাতালটিতে সর্বাধুনিক সবধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন, রোবোটিক অপারেশন, জিন থেরাপির ব্যবস্থা। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাদের জন্য রাখা হচ্ছে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ও মৌলিক গবেষণার জন্য আলাদা সেন্টার। রোগীবান্ধব হিসেব গড়ে তুলতে হাসপাতালটিতে থাকবে সানকেন গার্ডেন, রুফটপ গার্ডেন ও বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব সুযোগ-সুবিধা। এছাড়াও এখানে উন্নতমানের আধুনিক ব্যবস্থাপনার বহির্বিভাগ, ইনফো ডেস্ক ও ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টার থাকবে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এর বহির্বিভাগে প্রতিদিন পাঁচ থেকে আট হাজার রোগী সেবা নিতে পারবেন। তাদের জন্য মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে ৩০০ চিকিৎসকসহ মোট এক হাজার ৫০০ জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে রেফার্ডভিত্তিক হাসপাতালটিতে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তিন দফায় চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তাকে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ পাবেন আরও ১৪০ জন। উন্নত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি উন্নত গবেষণা ও প্রশিক্ষণের দিগন্ত প্রসারিত করা হবে। কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের সুবিধা থাকবে এই হাসপাতালে। এ লক্ষ্যে ৮০ জন চিকিৎসক ৩০ জন নার্স ও ১০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আরও ৬১০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এমএইচ/জেবি