শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

ঢাকামুখী রোগীর স্রোত ঠেকাতে মেডিকেল কলেজগুলো কতটা সফল

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০২২, ০৯:০৯ এএম

শেয়ার করুন:

ঢাকামুখী রোগীর স্রোত ঠেকাতে মেডিকেল কলেজগুলো কতটা সফল

মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং জেলা সদর হাসপাতালগুলোকে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব হাসপাতালে শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা মেলে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগে আক্রান্তদের সেবা মেলে বেশি। রোগী বেশি অসুস্থ হলে তাদের পাঠানো হয় জেলা সদরে। অবস্থা আরও জটিল হলে রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল হয় রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেরসকারি হাসপাতালে। এর ফলে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সবসময়ই রোগীর চাপ থাকে। ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ রোগী আসায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। এতে রোগীরা পরিপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হন।

ঢাকামুখী রোগীর এমন চাপ দূর করা ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার সংশ্লিষ্টরা। বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে দেশে তিন পর্যায়ের হাসপাতালের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে উপজেলা ও এর চেয়ে ছোট পরিসরের হাসপাতালগুলোকে প্রাথমিক পর্যায়ের ধরা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের ধরা হয় (১০০-২০০ শয্যাবিশিষ্ট) ও জেনারেল হাসপাতালগুলোকে (২৫০ শয্যাবিশিষ্ট)। কমপক্ষে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট হাসপাতালগুলোকে বলা হয় তৃতীয় বা টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল।


বিজ্ঞাপন


মানুষ যেন হাতের নাগালে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পায় সে লক্ষ্যে সব জেলায় অন্তত একটি মেডিকেল কলেজ, বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও আট বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যে আট বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ৬৪ জেলায় ৬৫০টি করে আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস শয্যা করার ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

বিকেন্দ্রীকরণে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে মোট সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি। ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৪টি জেলায় এসব মেডিকেল কলেজ রয়েছে।

সম্প্রতি দেশের ৩৮তম মেডিকেল কলেজ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে শেখ রেহানা মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ৩৫তম জেলা হিসেবে সরকারি মেডিকেল কলেজের অধিকারী হবে। 
দেশে সরকারি প্রতিটি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সব ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা সংবলিত নিজস্ব একটি হাসপাতাল থাকার কথা। টারশিয়ারি পর্যায়ের এসব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের অধীনে জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবায় হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা।

কিন্তু বাস্তবতা তাঁর উল্টো। এখন পর্যন্ত দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে অর্ধেকেরই নিজস্ব হাসপাতাল গড়ে তোলা যায়নি। স্থানীয় জেলা ও জেনারেল হাসপাতালগুলোয় প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করছেন এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে সেবা পাওয়ার কথা ছিল তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। 


বিজ্ঞাপন


অধিকাংশ মেডিকেলে হাসপাতাল পূর্ণভাবে চালু হয়নি
গত এক দশক অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ১৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে এখনও নিজস্ব হাসপাতাল চালু হয়নি, আর হলেও জনবল ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে জনগণ তাদের কাঙিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত। ফলে রোগীদের ঢাকামুখী স্রোত থেকেই যাচ্ছে।

কিশোরগঞ্জে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১১ সালে। কিন্তু এর হাসপাতাল চালু হয়েছে নয় বছর পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ। তবে হাসপাতালটি এতোদিনেও পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিতে না পারায় জনমনে প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসকই ডেপুটেশনে কর্মরত। স্থায়ী নিয়োগে নার্স থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অপরদিকে হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছতাকর্মী পদে স্থায়ী কোনো লোকবল না থাকায় অস্থায়ী ভিত্তিতে লোকবল দিয়ে কাজ চলমান আছে। লোকবল সংকট ও অব্যবস্থাপনায় হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবার করুণ অবস্থা পার করছে।

লোকবল ঘাটতি নিয়েই হাসপাতালটি করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছে। ফলে রোগীরা নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এলাকাবাসী একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

অপরদিকে ২০১৪ সালে স্থাপিত সরকারি রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে এখনও হাসপাতাল চালু হয়নি। মেডিকেলে প্রথম ব্যাচ তাদের ইন্টার্ন সম্পন্ন করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। নিজস্ব হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালে জনবল ও অবকাঠামো না থাকার কথা বলে চমেকে ইন্টার্নের দাবি করলেও দ্বিতীয় ব্যাচ বর্তমানে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট রাঙামাটি সদর হাসপাতালেই ইন্টার্ন করছেন। তবে এ নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ফলে আধুনিক সুবিধা সংবলিত হাসপাতালের অভাবে রাঙামটির সাধারণ জনগণকে হয় চট্টগ্রাম, নয়তো ঢাকায় আসতে হচ্ছে। মেডিকেল কলেজ থাকার কোনো বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন না জেলাবাসী।

একই অবস্থা সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২০১৭ সালের পর স্থাপিত সাতটি মেডিকেল কলেজে এখনও হাসপাতালই চালু হয়নি। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ।

২০১৫ সালে স্থাপিত মেডিকেলটি ঢাকার পুরাতন মেডিকেল কলেজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করোনা রোগীদের সেবা প্রদান করেছে। এই হাসপাতালটি ২০১৪ সালে মেডিকেল কলেজ ঘোষণার আগেই চালু হয়েছিল। কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তুলনামূলক ভালো কাজ করছে।

প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে  
ঢাকামুখী রোগীর স্রোত থামাতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল? জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি মনে করি সারাদেশে যদি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। আমরা হাসপাতালে করোনাকালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করেছি এবং তা চলমান আছে। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। তবে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নই।

‘আমাদের চিকিৎসক, আউটসোর্সিং স্টাফসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকবলের সংকট রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিরও সংকট আছে। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে আমরা মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দিতে পারছি না। তবে সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি পুরাতন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মতো আমরা পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পাই তাহলে প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা প্রদান এবং স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের যে লক্ষ্য তা পূরণ করতে পারবো বলে আশা করি।’

অপরদিকে নির্মিতব্য হাসপাতাল কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হলে শিগগিরই নিজস্ব হাসপাতাল চালুর মাধ্যমে পার্বত্য জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করতে প্রত্যয়ী রাঙামাটি মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। 

বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি
স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ। 

ঢাকা মেইলকে ডা. বেনজির বলেন, ‘সকল রোগী যদি ঢাকায় আসে বা মোটা দাগে ঢাকা মেডিকেলে যায় তাহলে চিকিৎসাটা তো ঠিকমতো দেওয়া সম্ভব না। আমাদের দেশে পাঁচ শতাধিক উপজেলা রয়েছে। সেসব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যদি ভালো সার্ভিস দেয় তাহলে জেলা হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে। আবার জেলা হাসপাতালগুলো যদি ভালো সার্ভিস দেয় তাহলে মেডিকেল কলেজগুলোতে চাপ কমবে। আমাদের আটটি বিভাগ রয়েছে। সেগুলোতে যদি বিশেষায়িত সেবা চালু হয় তবে ঢাকায় এত লোক আসবে না। এতে রোগীদের ভালো মানের সেবা বেশি দেওয়া যাবে, খরচ কমে যাবে, স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে।’

প্রতি জেলায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিষয়ে আইইডিসিআরের সাবেক এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ হলেই ভালো সেবা পাওয়া যাবে এটা বলা যায় না। আমাদের হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ এবং প্রযুক্তিগত সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে যেখানে ভালো অবকাঠামো থাকার পরেও জনবল ও চিকিৎসা উপাদানের জন্য সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

সেবার মানোন্নয়নে করণীয় বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘সেবার মান বাড়াতে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি কিনলেন তেল নেই, ড্রাইভার আছে গাড়ি নেই এমন হলে তো হবে না। নতুন মেডিকেলগুলোর ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকম হয়েছে। সমন্বিতভাবে কার্যক্রম ছাড়া দেশের অর্থের অপচয় ঘটে। এখানে ইনভেস্ট হয় কিন্তু পর্যাপ্ত আউটপুট পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন আমাদের মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যেটা করোনাকালে আরও স্পষ্ট হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে আমলাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে হবে।’

এমএইচ/এইচজে/এমআর/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর