শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রোগীতে ঠাসা পঙ্গু হাসপাতাল, আর্তনাদে ভারী পরিবেশ

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৯ মে ২০২২, ০৯:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

রোগীতে ঠাসা পঙ্গু হাসপাতাল, আর্তনাদে ভারী পরিবেশ

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, সংক্ষেপে নিটোর। দেশে দুর্ঘটনাজনিত আঘাতপ্রাপ্ত জটিল রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত এই হাসপাতালটি। পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠাটিতে প্রতিদিন সারাদেশ থেকে শতাধিক রোগী আসেন। ২৪ ঘণ্টাই দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের আর্তনাদে ভারী থাকে এখানকার জরুরি বিভাগের পরিবেশ। স্বাভাবিক অবস্থাতে রোগীর চাপে হিমশিম খাওয়া হাসপাতালটির পরিস্থিতি ঈদ বা উৎসবে ভিন্নমাত্রা পায়। ফলে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আর রোগীদের সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় বিড়ম্বনা।

এই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশিরভাগকেই মাসের পর মাস অবস্থান করে চিকিৎসা নিতে হয়। ফলে এক হাজার শয্যার হাসপাতালটিতে সবসময় সিটের তুলনায় অধিক রোগী সেবা গ্রহণ করেন। এতে রোগীদের মেঝে এমনকি বেলকনিতে অবস্থান করতে দেখা যায়।


বিজ্ঞাপন


কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত গুরুতর আহত রোগীদের বেশিরভাগ সময়ই ভর্তি নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। ফলে আসন সংখ্যার তুলনায় অধিক রোগীকে সেবা দিতে হয়। যেমন গত ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের কথা জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের তথ্যমতে, এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এক হাজার ২৫০ জনেরও বেশি রোগী ভর্তি হন। এ অবস্থায় নিজেদের সক্ষমতার বাইরেও রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রোগীর চাপ ভর্তি বিড়ম্বনা

সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ ও আধুনিক অর্থপেডিক হাসপাতালটিতে কোনো শয্যা খালি নেই। ঈদপরবর্তী সময়ে রোগীতে ঠাসা প্রতিটি ওয়ার্ড। শয্যা না পাওয়া রোগীদের স্থান হয়েছে ওয়ার্ডের মেঝে, ব্যালকনিতে এমনকি রোগীর স্বজনদের চলাচলের পথেও রোগীদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। অপারেশন থিয়েটার, এক্সরেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনেও রোগী ও স্বজনদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ফলে দূর-দুরান্ত থেকে আসা তুলনামূলক কম মারাত্মক রোগীরা ভর্তি না হতে পেরে জরুরি বিভাগের সামনে অপেক্ষমাণ। অনেকে ভর্তি হতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।

নোয়াখালী থেকে আসা ট্রাকচালক নুরুল আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি গত ২২ এপ্রিল রাতে ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত হই। এতে আমার বাম পা ভেঙে যায়। পরদিন এখানে আসার পর আমার পায়ে প্লাস্টার ও টানা দেওয়া হয়। সেদিন ভর্তি করা হলেও পরদিন আমাকে ১৪ দিনের জন্য রিলিজ দেওয়া হয়। এ সময় অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে পুনরায় হাসপাতালে আসি। তাদের কথামতে শুক্রবার এলেও তারা ভর্তি নেননি। একদিন অপেক্ষার পরেও এখন পর্যন্ত ভর্তি হতে পারিনি। হাসপাতালে কোনো বেড খালি নেই, বারান্দাও রোগীতে ভরপুর। আমার স্বজনরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’


বিজ্ঞাপন


উত্তরবঙ্গ থেকে আনা রহিম-সখিনা (ছদ্মনাম) দম্পতিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটে বসে থাকতে দেখা যায়। আর তাদের ছেলে বাবার ফাইল নিয়ে এক রুম থেকে অপর রুমে দৌড়াদৌড়ি করছেন। ঢাকা মেইলেকে তারা বলেন, গত প্রায় তিন মাস আগে গাছ থেকে পড়ে রহিম মিয়ার পা ভেঙে যায়। এলাকায় চিকিৎসা গ্রহণে তার অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় ঢাকায় এসেছেন। তবে সকালে এলেও দুপুর দুইটা পর্যন্ত তিনি ভর্তি হতে পারেননি। তার ছেলে ভর্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সুনির্দিষ্ট কারণ না জানলেও তাদের ধারণা রোগীর চাপ বেশি থাকায় তারা ভর্তি হতে পারছেন ন। এর জন্য ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর আধিক্য ও শয্যা খালি না থাকাকে দায়ী করছেন তারা।

hos2

এদিকে ভর্তি হতে পারা রোগীদের বিড়ম্বনারও শেষ নেই। নিটোরে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কিশোরগঞ্জ থেকে আসা আব্দুল আজিজ (ছদ্মনাম) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার মা ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়েছেন। উনাকে প্রায় সুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। সেবা পেয়েছি বলেই তিনি সুস্থ হয়েছেন। তবে বিড়ম্বনাও কম ছিল না। প্রথমত তাকে ভর্তি করতে বেগ পেতে হয়েছে। অনেক ঝামেলার পর ভর্তি হতে পারলেও ভালো সিট পাওয়া কষ্টকর। ভেতরে প্রত্যেকটি কাজের জন্য টাকা ব্যয় করতে হয়। এখানে শক্তিশালী বকশিশ কালচার গড়ে ওঠেছে। রোগীর চাপ এত বেশি যে, অপারেশনের তারিখ পাওয়া কঠিন, সিরিয়ালের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। সিট ও সুযোগ সুবিধার তুলনায় রোগী বেশি থাকায় সম্ভবত এর প্রধান কারণ। মানুষ সেবা পেতে বাধ্য হয়েই বকশিশসহ তদবিরে জড়াচ্ছে।’

এছাড়া হাসপাতালে আনসার নিয়োগ থাকলেও প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটে বলেও জানান তিনি।

রোগী বৃদ্ধির কারণ হাসপাতালের সক্ষমতা

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত সারাদেশে ১৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছে ২৪৯ জন। এদের মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী ৯৭ জন। যা মোট দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা হাজারের ওপর।

এসব দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের একটা বড় অংশ ভর্তি নিটোরে। প্রতি বছরই উৎসব মৌসুমে রোগীর চাপ বাড়ে, তবে এ বছর তা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল গণি মোল্লা।

জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এ বছর ঈদে রোগীর চাপ কিছুটা বেশি। ইমার্জেন্সির দিকে গেলে আমাদেরই মন খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশিরভাগই ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী। যাদের বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। উৎসবে এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। আমরা সে কাজ করে যাচ্ছি। ঈদের ছুটিতে থাকার পরেও কাছাকাছি থাকা অধ্যাপকসহ অনেক চিকিৎসকরা কাজে যোগ দিয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞ অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকসহ আমি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। আমি ঈদের নামাজও হাসপাতাল মসজিদে আদায় করেছি।’

hos3

হাসপাতালের সক্ষমতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘নিটোর চিকিৎসাসেবা প্রদানে সম্পূর্ণ সক্ষম। আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর কোনো সংকট নেই, তারা সবাই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। আমাদের এখানে শয্যা রয়েছে এক হাজার। আমরা এর বাইরেও রোগীদের নিয়মিত সেবা প্রদানে করে যাচ্ছি। করোনাকালে আমাদের নতুন ভবনের দুটি ফ্লোর ডেডিকেটেড ছিল। এখন যেহেতু করোনা রোগী নেই এবং সাধারণ রোগীদের চাপ বেড়েছে তাই সেই শয্যাগুলোও তাদের দিয়ে দেওয়া হবে। এতে মেঝে থাকা রোগীর সংখ্যা কমবে। আমাদের এখানে সারাদেশ থেকে রোগী আসে। এসব রোগীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসা শুরু করতে হয়। ফলে আমাদের শয্যা খালি থাকুক বা না থাকুক এসব রোগীর সেবা দিতে হয়।’

সেবা প্রদানে নিটোর সফল দাবি করে অধ্যাপক আব্দুল গণি বলেন, ‘এই হাসপাতাল তার কাজের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। এখানে সেবা না পেয়ে রোগী ফিরে গেছে এমন কখনও হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের এখানে সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঈদে রোগী বাড়ায় জরুরি বিভাগে আমাদের সিনিয়র চিকিৎসকরাও দায়িত্ব পালন করছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে সকল বিভাগে তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে মারাত্মকভাবে আহত রোগীরা আসেন। আমাদের কাছে আসার পর মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। তবে হ্যাঁ, অনেকের পা-হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। তাই দুর্ঘটনা যেন না হয় সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। বিশেষত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। যেহেতু এর বেশিরভাগ ভুক্তভোগী তরুণ, তাই এ বিষয়টিতে সমাজ ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের জীবনের মূল্য বোঝাতে হবে।’

এমএইচ/জেবি 

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর