বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদয়হীন কারবার!

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৬ জুন ২০২২, ১০:৪০ এএম

শেয়ার করুন:

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদয়হীন কারবার!

কুমিল্লার বাসিন্দা মাওলানা সাইফুদ্দিন স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে গত পাঁচ দিন ধরে ভর্তি আছেন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। তার হৃদকম্পন স্বাভাবিক নয়, ফলে চিকিৎসকরা তার হার্টে ব্লক রয়েছে বলে ধারণা করছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি এনজিওগ্রাম করানোর জন্য অপেক্ষমাণ আছেন, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় করোনারি এনজিওগ্রাম বলে। করোনারি এনজিওগ্রাম হলো এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে এক্স-রে ইমেজিং ব্যবহার করে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিগুলো, যাকে করোনারি আর্টারি বলা হয়, সেখানে হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে কি না পরীক্ষার মাধ্যমে তা দেখা হয়।

তবে হৃদরোগ হাসপাতালে এনজিওগ্রামের জন্য সাইফুদ্দিনের এটিই প্রথম আসা নয়। এর আগেও তিনি ভর্তি হয়েছেন, তবে এনজিওগ্রাম করাতে পারেননি। সাইফুদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি গত রমজানের ১৮ দিন আগেও এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। হার্টে ব্লক থাকার আশঙ্কা থাকায় এনজিওগ্রাম করাতে এসেছিলাম, কিন্তু পরীক্ষা হয়নি। অনেক চেষ্টা করেছি। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসকদের পেছন পেছন ঘুরেছি, কিন্তু উনারা এনজিওগ্রাম করাননি। উনাদের কথা টাকা ব্যবস্থা করে রিং বসানোর প্রস্তুতি নিয়ে আসুন, পরে এনজিওগ্রাম করাবো। ব্লক ধরা পড়লে সাথে সাথে রিং বসিয়ে দেবে। রিং বসাবো এটা নিশ্চিত না করলে তারা পরীক্ষা করাবেন না। আমি গরিব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবো। এলাকার বিত্তবানদের বলেছি। তারা বলেছেন ব্লক থাকলে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু আমি তো পরীক্ষাই করতে পারছি না। এবার আবার ভর্তি হয়েছি। চেষ্টা করছি এনজিওগ্রাম করানোর। স্যার বলেছেন করিয়ে দেবেন।’


বিজ্ঞাপন


হাসপাতালটিতে এনজিওগ্রামের উদ্দেশ্যে ভর্তি অন্যান্য রোগীর ভাষ্যও একই। চিকিৎসকরা জিজ্ঞেস করেন, তারা রিং বসানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন কি না। বলেন পরীক্ষা করানোর আগেই টাকার জোগাড় করতে। রোগীরা যদি বলেন তারা এত টাকা ব্যবস্থা করতে পারবেন না, তখন তাদের রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় তারা যেন প্রস্তুতি নিয়ে এরপর আসেন।

কিশোরগঞ্জ থেকে হাসপাতালটিতে আসা শামীম মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি এক বছর যাবত হার্টের সমস্যায় ভুগছি। এলাকায় ডাক্তার দেখিয়ে নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছিলাম। তবে গত কয়েক দিন সামান্য ব্যাথা অনুভব ও অন্যান্য সমস্যা বোধ করায় ডাক্তার ব্লক থাকতে পারে জানিয়ে এনজিওগ্রাম করাতে বলেছেন। এজন্যই এখানে আসা। আমি ছয় দিন যাবত এখানে ভর্তি আছি। আগামীকাল আমার এনজিওগ্রাম হওয়ার কথা রয়েছে। স্যাররা রিং বসানোর টাকা আছে কি না জিজ্ঞেস করেছেন। বলেছি আগামীকাল সকালে আমার ভাই টাকা নিয়ে আসবে। লাখ-দেড় লাখ টাকা লাগবে বলেছেন। কিন্তু আমি ছোট ব্যবসা করি। এত টাকা হঠাৎ করে ব্যবস্থা করা কষ্টকর। এটা বলার পর উনারা বলেছেন ব্যবস্থা করে পরে আসতে। আমাদের ইচ্ছা পরীক্ষাটা করে নিশ্চিত হওয়া। যদি লাগেই তাহলে যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করবো। কিন্তু রিং বসাবো এটা না বললে উনারা পরীক্ষাই করাবেন না। তাই ভাই টাকা নিয়ে আসবে বলেছি।’

hospital2

তার স্ত্রী নিলুফার বেগম ঢাকা মেইল বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর অন্যান্য রোগীদের স্বজনদের থেকে শুনেছি, লাগলে রিং বসাবো, প্রস্তুতি আছে--এটা না বললে নাকি তারা এনজিওগ্রাম করায় না। আমরা এখন যে বিছানায় আছি, এই বিছানার আগের রোগীর কাছে যখন জানতে চেয়েছিল তারা বলেছিল প্রস্তুতি নাই। আপাতত পরীক্ষা করবে, রিং লাগলে টাকা ব্যবস্থা করে আবার আসবে। তখন স্যার আর কোনো কথা না শুনেই তাদের রিলিজ দিয়ে দিছে। বলছে এই পরীক্ষা কোনো খেলা না। প্রস্তুতি নিয়ে পরে আসবেন। আমরা তখন ফ্লোরে ছিলাম। তারা অনেক অনুরোধ করলেও উনারা কোনো কথা শোনেননি। তাই আমরা বলেছি আমাদের প্রস্তুতি আছে।’


বিজ্ঞাপন


পাশের শয্যার আব্দুল আলিম জানান, তিনি এনজিওগ্রাম করিয়েছেন। তাদের প্রস্তুতি না থাকলেও অপর রোগীদের অভিজ্ঞতা দেখে প্রস্তুতি আছে বলেছিলেন। তার এনজিওগ্রামে ব্লক ধরা পড়েনি। এখন তিনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাবেন। পরীক্ষাটা না করাতে পারলে হয়তো আতঙ্কিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে টাকার ব্যবস্থা করে আবার আসতে হতো।

বিয়ে করবেন না, কিন্তু পাত্রী দেখছেনএমন তো হতে পারে না

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চিকিৎসা করতে এলে যে রোগ ধরা পড়বে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগী সেই চিকিৎসা গ্রহণ করবে। রোগী যদি না চান তাহলে সেই চিকিৎসা প্রদান করা হবে না। এক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার তো প্রশ্ন আসে না। কিন্তু বিষয়টি এমন যে আপনি ভাবলেন বিয়ে করবেন না অথচ মেয়ে দেখতে বের হলেন। ১০ দিন বিভিন্ন জায়গায় মেয়ে দেখলেন, এরপর বন্ধ করে দিলেন। কারণ বিয়ে তো আপনি করবেন না। ইচ্ছা হয়েছে তাই দেখেছেন। এই ঘটনাটি এরকম। আপনি এনজিওগ্রাম করবেন চিকিৎসা করার জন্য, কিন্তু চিকিৎসা করাবেন না।’

এনজিওগ্রাম একটি জটিল পরীক্ষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে দুটি সিদ্ধান্ত হতে পারে। প্রথমত, এই মুহূর্তে কিছু লাগলে করবো অথবা আমার এখন টাকা-পয়সার সমস্যা আছে, তাই কী সমস্যা আছে এবং করণীয় কী আমাকে সেটা বলে দিন, আমি মাসখানেক পর চিকিৎসা করাবো। দুইটাই সম্ভব হতে পারে। এনজিওগ্রাম কোনো ছেলে-খেলা নয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। হার্টের রক্তনালিতে বারবার ক্যাথেটার ঢুকানো, এটা তো সখের জিনিস না। সারাবিশ্বেই সম্ভব হলে সাথে সাথে রিং বসিয়ে দেয়। কিন্তু রোগী যদি সামর্থ্যবান না হয় সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই। চিকিৎসকরাও রোগীদের সেই পরামর্শই দেন।’

ক্যাথল্যাবের সামনেই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবস্থান

সরকারি হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের চেম্বারে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের প্রবেশ ও অবস্থানে সরকারি সরাসরি কোনো বিধি-নিষেধ নেই। তবে রোগীদের সুবিধার্থে তাদের জন্য নির্দিষ্ট দিন ও সময় বেঁধে দেওয়া হয়। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও এ ধরনের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। ফলে হাসপাতালটির ক্যাথল্যাবের সামনের ‘কনফারেন্স’রুমেই তাদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।

হাসপাতালের একতলায় অবস্থিত ক্যাথল্যাবের এনজিওগ্রাম রুমে রোগীর সাথে একজন স্বজন প্রবেশ করতে পারে। সেখানে অন্যান্য স্বজনদের বসার জন্য পর্যাপ্ত স্থান নেই। ফলে রোগীর স্বজনরা কনফারেন্স রুমে বসতে চান। তবে সেখানে তাদের বসা নিয়ে আপত্তি জানান বিক্রয় প্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে এক রোগীর স্বজন আরজু মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার মামাতো বোনের স্বামীর এনজিওগ্রাম করানো হবে। রোগীর সাথে তার ছোট ভাই ক্যাথল্যাবে ঢুকেছেন। তখন আমি আর আমার বোন ওইরুমে বসতে যাই। তখন তারা আমাদের বাধা প্রদান করে বলেন, এখানে বসা যাবে না। রুমটিতে লাখ লাখ টাকার মেডিকেল সরঞ্জাম রয়েছে। আর রুমটি তাদের জন্য।’

hospital3

এ বিষয়ে কর্তব্যরত আনসার সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা বসতে পারেন। এটা রোগীর স্বজনদের জন্যই।’ তবে পাশেই থাকা গার্ড বলেন, ‘না ওইখানে বসা যাবে না। আপনারা সামনে তিনটি সিট অথবা বাইরে গিয়ে বসেন। ওইখানে অনেক মূল্যবান সরঞ্জাম আছে। কিছু হারালে দায় কী আপনারা নেবেন? ওইটা কোম্পানির লোকদের জন্যই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা এই রুমটাতে বসি। এখানে রিংসহ মেডিকেল সরঞ্জাম আছে। আমরা স্যারদের চাহিদা মতো এখান থেকে তা সরবরাহ করি।’

হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির লোকদের অবস্থানের বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক জামাল উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সারা বিশ্বেই এই ধরনের সুযোগ আছে। আমরা হাসপাতালে শতভাগ ওষুধ সরবরাহ করতে পারি না। কারণ আমাদের এখানে যে সংখ্যক রোগী ভর্তি হয় এবং বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসে তাদের সবাইকে ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। কিছু ওষুধ রোগীদের ক্রয় করতে হয়। চিকিৎসকরা যে ওষুধ দেন তারা সেই ওষুধ কিনবেন। সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ রয়েছে। তারা তা দেখে, সে অনুযায়ী ওষুধগুলো ফার্মেসিতে সাপ্লাই করে থাকেন।’

কনফারেন্স রুমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওখানে কোনো কনফারেন্স রুম নেই। ক্যাথল্যাবের পাশে কনফারেন্স রুম থাকার সুযোগ নেই। ক্যাথল্যাবের পাশে প্যাশেন্ট রুম এবং প্যাশেন্ট এটেনডেন্স রুম রয়েছে। রোগীর স্বজনরা সেখানে বসেন। তারা এখানে অপেক্ষা করেন এবং পরীক্ষা শেষে চিকিৎসক তাদের সঙ্গে কথা বলে রোগীর চিকিৎসায় করণীয় বিষয়ে জানান।’

এমএইচ/জেবি 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর