images

হেলথ

আর্থিক সহায়তা নয়, দৃষ্টি ফিরে পেতে চান অভিভাবকহীন ইমরান

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:১৪ পিএম

তিন মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালের শয্যায় দিন কাটছে ২৪-এর বীর মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বর্তমানে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। পিতা-মাতাহীন ইমরান শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে অংশ নিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে এক চোখ পুরোপুরি হারিয়েছেন, আর অন্য চোখের দৃষ্টিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ইমরানের জীবনের সংগ্রাম ও পরিবার না থাকার বেদনা ইতোমধ্যে নাড়া দিয়েছে দেশের কোটি মানুষের হৃদয়ে। পরিবারের ঘাটতি ও কষ্ট লাঘবে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান তার দায়িত্ব নিয়েছেন, করেছেন আর্থিক সহায়তাও। আহতদের জন্য বরাদ্দ সরকারি আর্থ সহায়তাও পেয়েছেন তিনি। তবে অর্থ নয় বরং সুচিকিৎসার মাধ্যমে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেতে চান ইমরান।

নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে ঢাকা মেইলকে ইমরান বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে যদি চিকিৎসা নেওয়া হয় তাহলে আমার চোখ ঠিক হয়ে যাবে। হাসপাতালে ওরা মনে হয় না কখনও বলবে এখানে বা ওইখানে যান। সরকারের থেকে এক লাখ টাকা আসছে। কিন্তু আমি তো টাকা চাই না। টাকা দিলেই তো সব শেষ হয়ে গেছে। আমি চাই আমার চোখটা ভালো হোক। উপদেষ্টারা কেউ যদি আসতো, আমি তাদের রিকোয়েস্ট করতাম, কোনোভাবে তারা যেন আমাকে সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড পাঠায়। যেহেতু আমি চোখে আলো বুঝতে পারছি, হয়তো চোখটা ভালো হবে। কিন্তু তারা তো আসেনি। শুধু বিকাশের মাধ্যমে টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছে।’

মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। ছোটবেলায় হারিয়েছেন মা-বাবাকে। মৃত্যুর আগে তাকে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে এক খালার কাছে রেখে গিয়েছিলেন মা। সেই খালার কাছেই বেড়ে ওঠা। তবে আর্থিক অনটন ও অবহেলা সহ্য করতে না পেরে এক সময় তিনি খালার বাড়িও ছেড়েছেন। ছোটখাটো কাজের পাশাপাশি চালিয়েছেন নিজের পড়ালেখা। এসএসসি পাস করে এ বছরই ভর্তি হয়েছিলেন টঙ্গী কলেজে। তবে ক্লাসে যাওয়া হয়নি তার। 

আরও পড়ুন

পায়ে বুলেট নিয়ে কাতরাচ্ছেন শাহাদাত

দুই মাসেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাননি আন্দোলনে আহত সাজেদুল

পরিবারের কথা জানতে চাইলে আবেগতাড়িত কণ্ঠে ইমরান বলেন, ‘আমার পরিবারে কেউ নাই। বাবা-মা আগেই মারা গেছে। খালার কাছে থাকতাম, তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তারা নিজেরাই চলতে পারে না। তাদের একটা ৯ বছরের মেয়েও আছে। তাই এক সময় ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। যাত্রাবাড়ীসহ নানা জায়গায় কাজ করেছি। সর্বশেষ টঙ্গী বিসিকে একটা গার্মেন্টসে কাজ করতাম। এর মধ্যে ১৫ বছর পর একবার নিজের বাড়ি গিয়েছিলাম। দাদা-দাদি কিংবা চাচা-ফুফুরা সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। অনেক আদরও করেছে। কিন্তু এরপর দিনই তাদের আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের আচরণ দেখে চলে আসছি। আর কোনোদিন যাইনি। এখানে দেখার কেউ নাই। হাসপাতাল থেকে যে খাবার দেয় তাই খাচ্ছি।’

সাম্প্রতিক সময়ে তার অসহায়ত্বে কথা গণমাধ্যমে ওঠে এলে বিএনপির পক্ষ থেকে তার দায়িত্ব নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপির কয়েকজন নেতা এসেছিলেন, তারা আমার দায়িত্ব নেবেন বলেছেন। এরপর এক ঝুড়ি ফল ও দশ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। আমি তাদের বলেছি আমার অন্য কিছু লাগবে না। আপনারা শুধু আমার সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন। তারা দেখবেন বলেছেন।’

Imran

দেশের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা ও আবেগ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন ইমরান। ১৮ জুলাই বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টায় উত্তরা রাজলক্ষী ব্রিজের কাছে থাকা অবস্থায় গুলি লাগে। প্রথমে তাকে বাংলাদেশ মেডিকেল নিয়ে যাওয়া। সেখান তারা রাখেনি, পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে গত ২৯ আগস্ট চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পাঠায়।

চিকিৎসার তথ্য তুলে ধরে ইমরান বলেন, উত্তরার আজমপুরে আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হই। আমর ঠিক কতগুলো গুলি লেগেছে তা ঠিক বলতে পারি না। তবে এখন চোখে গুলি আছে। এক চোখে শুধু আলো বোঝা যায়, অপর চোখের পাশে গুলি লেগেছে। ওই চোখটা অল্প একটুর জন্য বেঁচে গেছে। এখন পর্যন্ত আমার চোখে তিনটা অপারেশন হয়েছে। আরেকটি লেজার সম্ভবত খুব দ্রুতই করবে।

আরও পড়ুন

কাছ থেকে গুলি, ঘাতক পুলিশের নাম বলে গেছে কিশোর সাগর

পুলিশের গাড়ি পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়, আমি সেন্সলেস হয়ে যাই

সর্বশেষ চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানকার চিকিৎসকরা বলেছেন, এখানে ট্রিটমেন্ট শেষ। তাদের যতটা করার তারা তা করেছেন। বাইরে থেকে যে ডাক্তাররা এসেছেন তারা শুধু দেখে চলে গেছেন। কোনো কিছু বলেননি। 

চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটিতে বর্তমানে গণঅভ্যুত্থানে আহত ৩০ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাদের প্রায় সবাই একচোখে দৃষ্টি হারিয়েছেন। কারো কারো উভয় চোখেই সমস্যা আছে। হাসপাতালে পক্ষ থেকে তাদের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ দেওয়া হচ্ছে। তাদের চিকিৎসায় বিদেশ থেকেও চিকিৎসক এসেছেন। তারা এখানের চিকিৎসার বিষয়ে এখানকার চিকিৎসকদের সাথে একমত যে, আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া দেওয়া হয়েছে। এরপরেও প্রয়োজনে তাদের বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। এরই মধ্যে কাউকে কাউকে রেফারও করা হয়েছে।

এমএইচ/জেবি