images

অর্থনীতি / সাক্ষাৎকার

খেলাপি ১৬ শতাংশ, সিঙ্গেল ডিজিটে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৩৭ পিএম

ব্যাংক না টিকলে দেশের অর্থনীতি টিকবে না
শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি ভঙ্গ করলে আমরা ছাড় দেই না
অনেক বড় গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছি

‘চলতি বছরে আমরা সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ আদায় করতে চাই। আমরা রেকর্ড ভাঙতে চাই। আমি আশাবাদী কারণ এ বছরের শুরুতে আমরা অপ্রত্যাশিত কিছু আদায় করেছি। বিভিন্ন জায়গায় আমরা যাচ্ছি। আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’ বলছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অন্যতম জনতা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার। ব্যাংকটিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জিরো ট্রলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত জনতা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আগে তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় ঢাকা মেইলের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক তারিক আবেদীন ইমন।

ঢাকা মেইল: আপনি যোগদানের পর থেকে ব্যাংককে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিভাবে কাজ করছেন?

আব্দুল জব্বার: আমি আসার পর প্রথমেই ১০১ দিনের একটা কর্মসূচি হাতে নেই। এটাই ছিল আমার মূল ভিত্তি। এখন পর্যন্ত যেটাই অর্জন হয়েছে এটার মাধ্যমেই হয়েছে। সবাইকে কাজে সম্পৃক্ত করার সুযোগ হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সাধ্যমতো তারা কাজ করেছে। এজন্য আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। যেখানে প্রতিষ্ঠান ঝিমিয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটাতে সবাই কাজ করছে। আমার একটা নির্দেশনা ছিল— অ্যাকচুয়াল যে পজিশন সেটাই বের করে আনতে হবে। বাড়লে বাড়বে, কমলে কমবে।

ঢাকা মেইল: জনতা ব্যাংকের বর্তমান আমানতের কি অবস্থা?

আব্দুল জব্বার: বর্তমানে জনতা ব্যাংকের প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার মতো আমানত রয়েছে। ডিপোজিট বাড়বে-কমবে এটা স্বাভাবিক। আমি যখন আসি তখন আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। আমি এসে একশ দিনের কর্মসূচি নেওয়ার পরে ডিপোজিট বেশ বাড়ল। ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি পর্যন্ত হয়। আবার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ যখন হয় তখন সরকারি ফান্ডগুলো ব্যবহৃত হয়, আমার এখানেও গভর্নমেন্ট ফান্ডগুলো ছিল। এখন সরকার বিভিন্ন কারণে তা নিয়ে যায়, পেমেন্ট করে, অন্যান্য কাজে লাগায়, বছরের শেষে দিকে কিংবা অর্থ বছরের শেষের দিকে এসে উত্থান-পতন ঘটে। আবার বাড়ে। এভাবেই চলে। যেমন এ বছরের শুরুতে আবার বাড়ছে।

আরও পড়ুন

খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামগ্রিক অর্থনীতিতে
খেলাপি ঋণের রেকর্ড
কেন কমছে না খেলাপি ঋণ?

ঢাকা মেইল: দেশের ব্যাংকগুলোর বর্তমানে প্রধান সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি আদায়ে আপনি কিভাব কাজ করে যাচ্ছেন?

আব্দুল জব্বার: আমাদের খেলাপি ঋণ বাড়ছিল। আমরা চাইলাম কিভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য ওপেন করা যায়। আগে প্রকাশ করাটাই ছিল কাজ। আমাদের খেলাপি কমানোর ক্ষেত্রে গোপন কিছু ছিল না। এটাকে হয়তো অন্যভাবে কমানো যেত খেলাপি না করে। সেই জায়গা থেকে আমরা বললাম, না, আমরা ওটা করব না। প্রকৃত যেটা সেটাই চলে আসল। এরপর যখন খেলাপি করা হয়ে যায় তখন তো গ্রাহকরা বলবে রেগুলার না থাকলে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে না। আমি একটা পয়েন্টে খুব স্ট্রং ছিলাম যে আমি কোনো অবস্থাতেই সুযোগ দিতে রাজি না। ব্যাংক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনো কিছু করতে রাজি না— গ্রাহকের কাছে যখন এই বার্তাটা যাবে তখন বাধ্য হয়ে টাকা দিতে থাকবে। গ্রাহকদেরকে কঠোর বার্তা দেওয়ার কারণে পরে তারা দেখল যে আর টাকা না দিয়ে উপায় নাই, ব্যাংক অ্যাকশনে যাচ্ছে, তখন তারা বাধ্য হয়ে টাকা দিচ্ছে। আমরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে সিস্টেমে আসতে হবে। সিস্টেমের বাইরে যাওয়া যাবে না। খেলাপিদের তালিকায় অনেক রাঘব বোয়ালও থাকে। তাদেরকেও একই ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। অনেক বড় বড় গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা টাকা আদায় করেছি।

ঢাকা মেইল: গত বছরের তুলনায় এ বছর কি পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমানোর টার্গেট ছিল? আপনারা কেমন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন?

আব্দুল জব্বার: আমাদের পরিকল্পনাটা বিভিন্নভাবে নেওয়া হয়। কিছু পরিকল্পনা থাকে পাঁচ বছরের, কিছু থাকে ১০ বছরের। আমরা আশা করছি আমরা চার বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসব। সরকার যদি আদায়ের ক্ষেত্রে আরও কঠোর হয় সেক্ষেত্রে আরও কম সময় লাগতে পারে। তারা যে টাকা নিয়েছে সেটা ইনভেস্ট করেছে। তারা তো সেটা পাচার করেনি। সেটা থেকে রেভিনিউ করেই তারা টাকাটা দেবে। এজন্য সময় লাগে। এখন খেলাপি ঋণ ১৬ পার্সেন্ট আছে। প্রতি বছর ১-২ পার্সেন্টের মতো টার্গেট থাকে। ২০২৪ সালের মধ্যে ১৪ পার্সেন্টে আনা যায় কি না, এরপর পর্যায়ক্রমে ১৩-১২ এভাবে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এটাকে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। চলতি বছরে আমরা সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ আদায় করতে চাই। আমরা রেকর্ড ভাঙতে চাই। আমি আশাবাদী কারণ এ বছরের শুরুতে আমরা অপ্রত্যাশিত কিছু আদায় করেছি। বিভিন্ন জায়গায় আমরা যাচ্ছি। আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

ঢাকা মেইল: চলমান ডলার সংকট ও তারল্য সংকটে কিভাবে কাজ করছেন?

আব্দুল জব্বার: ডলার সংকট শুধু জাতীয় সমস্যা না, বিশ্বব্যাপী একটা সমস্যা। আমরা প্রথমে ভাবছিলাম কোভিডের পরে হয়তো ভালো হবে। কোভিটের পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলো। সাপ্লাই চেইনে সমস্যা হয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে— এটা তো সবাই জানে। ফলে ডলার সংকট আমাদের দেশেও চলে আসে। রেমিট্যান্স কমে যায়। আমাদের ব্যাংক অন্য ব্যাংকের তুলনায় সব থেকে বেশি আমদানি করে। সরকারের যে সাপোর্ট, সার, তেল, সরকারের অন্যান্য সংস্থার বিশেষ আমদানি— এগুলো বেশিরভাগই জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই সংকটকালেও আমরা এই কাজগুলো করে যাচ্ছি। যেভাবেই হোক ডলার আমরা ম্যানেজ করি। বাইরে থেকে রেমিট্যান্স আনার জন্য ক্যাম্পিং করি। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় দ্বিগুণ রেমিট্যান্স এসেছে। আর তারল্য সংকটের বিষয়টা হচ্ছে, দেশের বর্তমান ৬২ ব্যাংকেই তারল্য সংকট আছে। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই আছে। এটা আমরা বিভিন্নভাবে সমাধান করি। এটা তো সবসময় হয় না। মাঝেমধ্যে যখন হয় তখন আন্তঃব্যাংক একটা লেনদেন সিস্টেম আছে। আমরা বিভিন্নভাবে এটাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয় নাই।

ঢাকা মেইল: ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার কথা শোন যায়। বিশেষ করে এলসির ক্ষেত্রে। বৃহৎ এলসি করা ব্যাংক হিসেবে এটাকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?

আব্দুল জব্বার: এলসির মাধ্যমে প্রতারণার একটা কথা শোনা যায়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যাচাই করার। যতগুলা থিউরি আছে অ্যাপ্লাই করি এবং সেটা আরও উপর থেকেও যাচাই করা হয়। একটা সার্টেইন অ্যামাউন্ট যদি এলসি করা হয় সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও মনিটরিং থাকে। আমার মনে হয় না এখন খুব বেশি প্রতারণার সুযোগ আছে। আমদানি-রফতানির মাধ্যমে যদি হয়, আমরা আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করেই এলসি করি। অনেক সময় পেমেন্ট বিভিন্ন কারণে দেরি হওয়ায় পণ্য আসতে একটু দেরি হতে পারে। কিন্তু পণ্য আসে না এটা হয় না।

আরও পড়ুন

ঋণ পরিশোধে আবারও ছাড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
একদিনে রেকর্ড ২৪,৬১৫ কোটি টাকা ধার দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক
‘খেলাপিরা যতই শক্তিশালী হোক, ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে হবে’
একটি দেশ কখন, কেন দেউলিয়া হয়?
‘বছরে ৭০০ কোটি পাচার হয়ে যাচ্ছে, কারও কোনো কথা নেই’

ঢাকা মেইল: বর্তমানে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কি লক্ষ্যে কাজ করছেন?

আব্দুল জব্বার: আমরা এখন ছোট লোনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বিশেষ করে এসএমই খাতে আমাদের টার্গেট বেশি। কারণ বড় লোন থেকে রিটার্ন আনা কঠিন। কর্মসংস্থান বলেন, প্রফিট বলেন, জিডিপি বলেন— যাই বলেন না কেন একটা ইন্ডাস্ট্রি এস্টাবলিস্ট হতে ২-৩ বছর লেগে যায়। এজন্য আমরা ছোট লোনে গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি। উদ্যোক্তা তৈরি না হলে বাণিজ্য সৃষ্টি হয় না। আমি এই জিনিসটাকে খুব পজিটিভলি দেখি। কোনো উদ্যোক্তা আসলে আমি তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

ঢাকা মেইল: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো বাধা বা চাপের সম্মুখীন হয়েছেন কি না?

আব্দুল জব্বার: আমি কোনো চাপ অনুভব করি না। আমাকে কেউ চাপ দেয়ও না। আমি নেইও না। আমি গ্রাহকদের সাইকোলজি বুঝে কাজ করার চেষ্টা করি। তাদের ক্ষতি হোক এমন কোনো পদক্ষেপ আমি নেই না। কারণ তারা যদি টিকে না থাকে তবে ব্যাংক টিকবে না। ব্যাংক না টিকলে দেশের অর্থনীতি টিকবে না।

ঢাকা মেইল: ব্যাংকে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

আব্দুল জব্বার: ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে, নিয়মনীতি ভঙ্গ করলে আমরা ছাড় দেই না। কাউকে কোনো পানিশমেন্ট দেওয়ার পরে উপর থেকে তার জন্য কেউ সুপারিশ করতে আসলে আমি আমলে নেই না। আমি বলে দেই তাকে কেন পানিশমেন্ট দেওয়া হয়েছে সেটা তাকে জিজ্ঞেস করেন। শৃঙ্খলার জন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।

টিএই