সম্প্রতি চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে লেবাননের সরকার দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এদিকে আর্থিক দুরবস্থা সামলাতে হিমশিম হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কাকে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও উন্নত দেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চরম বিপাকে পড়েছে তারা।
কিন্তু একটি দেশ কি আসলেই দেউলিয়া হয়? আর হলেই বা তার পরিণতি কী হয়?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি দেশ কখনোই দেউলিয়া হয় না। দেশ দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টি আসলে ভুল ধারণা। প্রথমত যখন কোনো একটি দেশ ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয় তখন দেশটি দেউলিয়া হয় না বরং খেলাপি হয়। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো খেলাপি কোনো দেশ হতে পারে না। খেলাপি হয় সরকার।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ বলেন, রাষ্ট্র দেউলিয়া না হলেও সে ঘোষণা করতে পারে যে, আমি ঋণ শোধ করতে পারছি না। এই না পারার ঘোষণাটাই মূলত দেউলিয়াত্বের ঘোষণা।
তবে কোনো ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়া যায়। কিন্তু দেশের ক্ষেত্রে এমনটি সম্ভব নয়। এ কারণে এ বিষয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনা চলতে থাকে। তবে এসব আলোচনার কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ঋণদাতারা দেশটির ওপর নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে। তারা নানা ধরনের শর্ত আরোপ করে। কর বাড়ানো, ব্যয় কমানো, সম্পদ বিক্রি করে দেয়া বা বন্ড ছাড়াসহ নানা চাপ দিতে থাকে ঋণদাতারা। এছাড়া প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, ভালো সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হবে। বা ঋণ পুনর্নবায়ন করা হয় ও শর্তে পরিবর্তন আনা হয়।
বিজ্ঞাপন
যখন কোনো দেশের সরকার পরিবর্তন হয়, তখন পুরনো সরকারের ঋণের বোঝা নতুন সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ে।
দেউলিয়া হওয়া কারণ:
ঋণখেলাপি বা দেউলিয়া হওয়ার নানা কারণ থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবাহের পরিবর্তন এবং অপর্যাপ্ত রাজস্ব। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করায় অক্ষমতার কারণে বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাইরে থেকে আমদানি করার মতো যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা না থাকলে সাধারণত দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। কোনো দেশে যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়, অর্থের অপচয় হয় এবং অপব্যয় হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়তে পারে। দেউলিয়া হওয়ার এটিও একটি বড় কারণ। বড় বড় প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি হওয়ায় দেউলিয়া হওয়ার পথ তৈরি করে।
এছাড়া বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ হলে, যুদ্ধ বেধে গেলে, উৎপাদন মারাত্মক হারে কমে গেলে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়- এমন পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চললেও দেশ দেউলিয়া হতে পারে।
ঋণ পরিশোধের উপায় বন্ধ হলে। তাত্ত্বিকভাবে একটি দেশের সরকার কর এবং বিনিয়োগ থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে। সাধারণ একজন মানুষ যেমন তার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে খরচ করে এবং ঋণ নেয় সরকারও তেমন বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। এর মানে হলো নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্দিষ্ট হারে মুনাফাসহ এই অর্থ ফেরত দেয়া হবে।
কোনো দেশের ঋণ সাধারণত দুই উপায়ে হয়। একটি হলো অভ্যন্তরীণ এবং আরেকটি বিদেশি ঋণ। এই দুই ঋণ মিলে তৈরি হয় জাতীয় ঋণ। বিদেশি ঋণ হলো বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তরিত বন্ড যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ হলো- দেশের মধ্যে থাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারি ঋণ।
অভ্যন্তরীণ ঋণ বার্ষিক মুদ্রানীতির মাধ্যমে কর বাড়িয়ে এবং নতুন মুদ্রা ছাপিয়ে পরিশোধ করা যায়। কিন্তু বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হলে অন্য মুনাফাভিত্তিক খাত থেকে আয়ের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। যা সরকার সবসময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
দেউলিয়া হলে করণীয় কী?
কোনো একটি দেশে দেউলিয়া হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ) এর দ্বারস্থ হতে পারে। এছাড়া আরও অন্য উৎস থেকেও ঋণ বা সাহায্য চাইতে পারে। তারা শর্ত দেয় যে, অবস্থার উন্নতি হলে এসব অর্থ সুদসহ ফিরিয়ে দেয়া হবে। আইএমএফ অর্থের পাশাপাশি তা খরচ করার জন্য নির্দিষ্ট খাত ও কারিগরি সহায়তাও দিয়ে থাকে। তবে এর বিপরীতে খরচ কমানো, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বাণিজ্য উন্মুক্তকরণের মতো শর্ত মানতে হয় দেশটিকে।
অনেক সময় দেউলিয়া হওয়া দেশ তার দেশের কোনো সম্পদ যেমন সেতু, বন্দর বা এমন কিছু ঋণদাতাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দিয়ে দেয়। যার মাধ্যমে তারা আয় করে ঋণ শোধ করে নিতে পারে। অথবা দেশের ভেতরে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিও বিক্রি করে দিতে পারে সরকার।
সূত্র: বিবিসি
একে