দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত খেলাপি ঋণ। নানা চেষ্টার পরও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না। গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আএমএফের শর্ত এবং ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ না কমায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে পরিকল্পনা করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত না দেওয়া এবং ওই টাকা সরিয়ে ফেলা যেন অলিখিত এক নিয়ম হয়ে গেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকের লোকজন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা যুক্ত। এই টাকা তারা অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলে। তাদের শাস্তির আওতায় না আনায় ঋণ খেলাপিরা অপ্রতিরোধ্য।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণ বেড়ে এক লাখ সাড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা
রোববার (২৮ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য দিয়েছে তাতে চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা৷ ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে তা ১৬ শতাংশ বা ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা বেশি। আর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরের চেয়ে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৯ শতাংশ বা ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। কারণ সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও তারা খেলাপি দেখানোর পক্ষে। বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতেই খেলাপি ঋণের প্রায় পৌনে এক লাখ মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি কারা, সংসদকে জানালেন অর্থমন্ত্রী
ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে আছে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, ঋণ খেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা ইত্যাদি।
ভিয়েতনাম, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশ আইনের শক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ অনেক কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ কেন সেটা পারছে না সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিবিসিকে বলেন, যারা বড় বড় অংকের ঋণ খেলাপি হয়েছেন, তাদের কখনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি। যেসব ব্যাংক এর সাথে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ভয় থাকে না।
সিরডাপের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাংকের দায়িত্ব হলো যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হবে তাদের সক্ষমতা যাচাই করা। তাহলে এখন প্রশ্ন- এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যদি খেলাপি হয় তাহলে ব্যাংক কীভাবে ঋণ দিলো? কী দেখে দিলো? আর এটা নতুন নয়, বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের কালচার চলছে। তাহলে বোঝাই যায় এটা ব্যাংকের টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটি কৌশল। আর এর পেছনে আছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। যে দলটি ক্ষমতায় আছে তাদের ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্টরা। বর্তমান সরকার ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। তাদের দায় নিতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এভাবে ঋণ খেলাপির নামে ব্যাংকের টাকা নিয়ে যাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: খাদের কিনারে দেশের ব্যাংক খাত: টিআইবি
যমুনা ব্যংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আসলে এখানে প্রকৃত খেলাপি অনেক কম। ইচ্ছাকৃত খেলাপিই বেশি। আর মোট খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশের জন্য অল্প কিছু প্রভাবশালী লোক দায়ী। এরা স্বেচ্ছায় খেলাপি। আসলে বছরের পর বছর এদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় দেশে ব্যবসার একটি ‘ঋণ খেলাপি মডেল' দাঁড়িয়ে গেছে। এটা হলো ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া এবং ফেরত না দেওয়া। এই টাকা দেশের বাইরে বা অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়। এটা পরিকল্পিতভাবে করা হয়। এর সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তা, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং প্রভাশালী ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত লোকজন আছে।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইন রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইনেও বড় কোনো ঋণ খেলাপির শাস্তির নজির নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং দেউলিয়া আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার পেছনে আইনের শিথিলতাকে দুষছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইন রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইনেও বড় কোনো ঋণ খেলাপির শাস্তির নজির নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং দেউলিয়া আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
অর্থ ঋণ মামলা পরিচালনাকারী একজন আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বিবিসিকে বলেন, খেলাপি ঋণের জন্য অর্থঋণ আদালত ২০০৩ এর আলোকে আদালতে মামলা করতে হয়। সেই আইন অনুযায়ী জামানত রাখা সম্পদ জব্দ করা বা নিলাম করে দিতে পারে। কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এরকম শাস্তি হলে সে সাধারণত আর ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হয় না। দেউলিয়া আইনে দেউলিয়া ঘোষিত হলে তিনি কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা ভোট দিতে পারেন না, প্রজাতন্ত্রের কোনো কাজে অংশ নিতে পারেন না, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও গ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশে সহস্রাধিক ব্যক্তি ঋণ খেলাপি বলে ব্যাংকগুলোয় তালিকাভুক্ত হলেও দেউলিয়া আইনে তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করার নজির নেই।
আরও পড়ুন: সিটি নির্বাচনে ঋণ খেলাপি ঠেকাতে ‘হার্ডলাইনে’ ইসি
তবে খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। খেলাপি ঋণ কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এটার জন্য যে ধরনের দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন, সেটার ঘাটতি আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেও অনেক ধরনের দুর্বলতা আছে বলে বলছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। বিবিসিকে তিনি বলেন, ঋণ খেলাপিদের অনেকেই বেশ শক্তিশালী। তারা এটা করে পালিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ কোন রকমের বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন না, কেউ আইনের মুখোমুখি হলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে কোনো সমাধান হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকও যেসব উদ্যোগ মাঝে মাঝে নেয়, সেগুলো স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা নানারকম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হন।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আইন আছে বেশ কিছু, কিন্তু সেগুলোর অনেক দুর্বলতা আছে। এমনকি টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ১২ বছর। কিন্তু সমস্যা হলো, আইন যেটুকু আছে, সেটারও প্রয়োগ নেই। সেই কারণে অনেকে মনে করেন, তারা ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত না দিলেও কিছু হবে না। অনেকে এভাবে টাকা বাইরেও নিয়ে যান।
জেবি