images

কৃষি ও পরিবেশ / জাতীয়

শহর-গ্রামজুড়ে প্লাস্টিকের দাপট, দায়ী কারা?

আব্দুল হাকিম

২৭ আগস্ট ২০২৫, ১১:১৬ এএম

  • সারাদেশে পলিথিন বর্জ্য প্রায় ৭৮,৪৩৩ টন
  • রাজধানীতে পলিথিন বর্জ্য প্রায় ৫,৯৯৬ টন
  • অবৈধ পলিথিন দৈনিক উৎপাদন ৫০ লাখ পিস
  • নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা প্রায় ১,২০০টি

কোথাও রাস্তায়, ড্রেনে কিংবা খাল-বিলে পড়ে আছে প্লাস্টিকের ঠোঙা ও বোতল, কোথাও নর্দমা আটকে দিচ্ছে পলিথিন। বহু বছর ধরে নানা ধরনের চেষ্টা করেও ঢাকাসহ দেশের শহর-গ্রামে প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ স্থানীয় প্রশাসন। রাজধানী থেকে জেলা সদর, উপজেলা থেকে গ্রাম—সবখানের চিত্র প্রায় একই।

দেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়।

পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও ৫৫ মাইক্রনের অধিক পলিথিনজাতীয় পণ্য বা মোড়ক উৎপাদনের অনুমোদন আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনুমোদিত কাঁচামাল আমদানি করেই নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। অনুমোদিত কারখানার মালিকরা ছোট কারখানাগুলোর কাছে কাঁচামাল বিক্রি করছে। এছাড়া বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাঁচামাল রিসাইকেল করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে।

10

জানা গেছে, শুধু রাজধানীতে ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগ থেকে উৎপাদিত মোট বর্জ্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। সারাদেশে এটি প্রায় ৭৮ হাজার ৪৩৩ টন। আর অবৈধ পলিথিন ব্যাগের দৈনিক উৎপাদন ৫০ লাখ বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে সমীক্ষায়। গত জুন মাসে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক সমীক্ষায় এই হিসাব উঠে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অন্তত ৩০০ কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয় পলিথিন।

সচেতন নাগরিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকতে পারে। লোকবল একটা কারণ। তাছাড়া দূষণ শুধু পলিথিনের কারণে হচ্ছে না, পরিবেশ দূষণের অনেক কারণ আছে। যেমন: ইটভাটা, কারখানা, কেমিক্যাল, ব্যাটারি। পলিথিনের পাশাপাশি সেগুলোও মনিটরিং করতে হয়।

11

প্রশাসন মাঝে মাঝে প্লাস্টিকবিরোধী প্রচার চালিয়েছে—লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, বাজারে অভিযান চালিয়ে পলিথিন জব্দ ও জরিমানা করেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ স্থায়ী হয়নি। কয়েক দিন ব্যবহারে লাগাম এলেও দ্রুতই পুরনো অবস্থায় ফিরে গেছে বাজার। শীতকালে সমস্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ মানুষ আগুন জ্বালিয়ে হাত গরম করার সময় প্লাস্টিকও ফেলে দেন আগুনে। এতে সালফার, নাইট্রোজেন যৌগ, কার্বন মনোক্সাইড ও ডাইঅক্সিনের মতো বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, যা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা ও রক্তের দূষণের কারণ হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় সব সরকারি বিভাগ ও তাদের অধীনস্থ দফতরে সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সরকার জানিয়েছে, সব বিভাগ ও অধীনস্থ দফতরগুলোকে সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ১৭ ধরনের সামগ্রীকে ‘সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের ফাইল-ফোল্ডারের বদলে কাগজ বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উপকরণ, প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে কাপড় বা পাটের ব্যাগ এবং প্লাস্টিক বোতল ও গ্লাসের পরিবর্তে কাচের বোতল ও গ্লাস ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

12

পাশাপাশি তুলা, পাট বা জৈবভাবে পচনশীল উপাদানে তৈরি ব্যানার ব্যবহার, আমন্ত্রণপত্র ও প্রচারণামূলক সামগ্রীতে প্লাস্টিক লেমিনেশন এড়ানো, সভা-সেমিনারে কাগজ বা পরিবেশবান্ধব উপকরণে তৈরি খাবারের প্যাকেট ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, কাপ, স্ট্র ও কাটলারি ব্যবহার বন্ধ, প্লাস্টিক কলমের পরিবর্তে পেন্সিল বা কাগজের কলম এবং ফুলের তোড়ায় প্লাস্টিক এড়ানোরও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, টেকসই প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য, যাতে কার্বন-নিরপেক্ষ ও শূন্য-কার্বন উন্নয়নের পথ সুগম হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে, বিশেষ করে কার্যকর বর্জ্য ও প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা এবং বন সংরক্ষণ সংক্রান্ত উদ্যোগে। তিনি বলেন, প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব নিয়ে পলিথিন ব্যবহার এড়াতে হবে। পলিথিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি আইন অনুযায়ী ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হবে এবং এই উদ্যোগ সম্পর্কে শপিং সেন্টার ও দোকান মালিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

13

উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাকে যদি প্রশ্ন করেন বাজারে পলিথিন নিয়ে যাওয়া কেন বন্ধ হয় না? তাহলে এখানে আমি বলব, এখানে দুইটা সমস্যা। প্রথমত উৎপাদন, দ্বিতীয়ত খরচ। আপনি আমাকে বলুন তো আপনি কেন আপনার বাবার মতো করে বাসা থেকে ব্যাগটা নিয়ে যান না? এখন বিষয় হচ্ছে, কত কোটি মানুষের হাতে কত কোটি পলিথিন থাকবে সেটা সেই মানুষগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে সরকার সচেতনতার কোনো অংশ বাদ রাখেনি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নয়, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। শহর ও গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার বা ধ্বংসের মাধ্যমে দূষণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি চালাবেন এবং নিয়মিত অভিযান চালিয়ে দায়ীদের শাস্তি দেবেন। তবে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন হবে।

তারা বলছেন, শুধু সচেতনতা দিয়ে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করা সম্ভব নয়। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিকল্প না পেলে পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করে না। পলিথিন ব্যাগ সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষ এটি ছাড়তে চায় না। বাজারে সস্তা এবং কার্যকর বিকল্প না আসা পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বদলানো কঠিন। অথচ বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের প্রথম দেশ যা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু এখন বাজারে দেখা যাচ্ছে, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই নির্বিঘ্নে প্লাস্টিক ব্যবহার করছেন। মাছ, সবজি, মাংস থেকে শুরু করে ডাল, চাল, বিস্কুট, মিষ্টি, এমনকি ওষুধও মোড়ানো হচ্ছে পাতলা প্লাস্টিকের প্যাকেটে।

বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা ব্যাগ ছাড়া পণ্য নিতে চান না, একজন না দিলে অন্যজন দেবে, তাই সবাই একসাথে বন্ধ করলেই কেবল এটি সম্ভব।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, পলিথিন বা প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে এবং পরিপত্র জারি করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত বিকল্পের অভাবে ২০০২ সালের পরে মাত্র কিছুদিন মার্কেট মনিটরিং করা হয়েছে। এরপর উপযুক্ত বিকল্প না থাকায় পলিথিন বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক আবার বাজার সয়লাব শুরু হয়েছে। দুই-এক বছরের মাথায় পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।

তার মতে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিককে পুরোপুরি বাজার থেকে সরিয়ে দিতে হলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। এক্ষেত্রে প্রথমেই প্লাস্টিকের কাঁচামালের ক্ষেত্রে—আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর—সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এরপর ভোক্তা পর্যায়ে, অর্থাৎ কাঁচাবাজার বা মার্কেট লেভেলে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জনগণকে যতটা সম্ভব সচেতন করতে হবে।

শুধু হঠাৎ করে বাজার থেকে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সরিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না, কারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য এই ধরনের প্লাস্টিকের ওপর তাদের মানসিক নির্ভরশীলতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সরকারকে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ—প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে কাপড়ের তৈরি, কাগজের তৈরি বা পাটের তৈরি সুলভ ব্যাগ বাজারে সহজলভ্য করতে হবে। প্রয়োজনে কারিগরি শিল্প থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্যাগ বাজারে আনতে হবে। একইভাবে, অন্যান্য সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক যেমন প্লাস্টিকের তৈরি প্লেট, গ্লাস বা চায়ের কাপের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব, পচনশীল বা কাগজের তৈরি বিকল্প পণ্য উৎপাদন করতে হবে।

এএইচ/জেবি