- প্রতিদিন সড়কে গড়ে ঝরছে ২২ প্রাণ
- বছরে প্রাণ হারায় প্রায় ৮ হাজার
- পাঁচ বছরে নিহত ৩৭ হাজারের বেশি
- দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বাড়াচ্ছে মৃত্যু
রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক থেকে মহাসড়ক কিংবা গ্রামীণ পথ-সবখানেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়া চালক, ভাঙাচোরা রাস্তা আর সিগন্যালহীন মোড় মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুকূপ। শুধু একদিন বা এক মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে এভাবে ঝরে যাচ্ছে হাজারো প্রাণ। থামছে না ভুক্তভোগী পরিবারের আর্তনাদ। তবু জবাবদিহিতার আওতায় আসছে না দায়ীরা। আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় দোষীরা থেকে যাচ্ছে দণ্ডমুক্ত।
বিজ্ঞাপন
রাজধানী থেকে শুরু করে সারাদেশের চিত্র প্রায় একই। সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিনই প্রাণহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মহাসড়কে যেন গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বেপরোয়া চালকদের অস্বাভাবিক গতিকেই প্রধানত দায়ী করা হয় দুর্ঘটনার জন্য। গ্রামীণ সড়কগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। খানাখন্দে ভরা রাস্তা, আলো-সংকেতহীন মোড় আর অসচেতন পথচারীর কারণে দুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
দুর্ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি। অনেক চালক সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে, কারও কারও কাছে বৈধ লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। সড়কে নেমেই তারা প্রতিযোগিতা শুরু করে যাত্রী ওঠানো নিয়ে। কে আগে যাবে, কে বেশি যাত্রী তুলবে—এই অস্থিরতার ফল হয় দুর্ঘটনা। আবার কেউ কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে কিংবা গান শুনতে শুনতে গাড়ি চালায়, ফলে মনোযোগ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।
ভুক্তভোগীদের বেদনা সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। এক শিক্ষার্থীর পরিবার জানায়, ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে তাদের সন্তান। এক শ্রমজীবী পরিবারের হাহাকার আরও মর্মান্তিক—তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, ফলে তারা এখন অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি। প্রতিটি ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকে কেবল একজন নয়, পুরো পরিবারের বেদনা, যা পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায় না।

বিজ্ঞাপন
তবে কেবল চালকের ভুলেই দায় সীমাবদ্ধ নয়। সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও বড় কারণ। অনেক সড়ক দীর্ঘদিন সংস্কার করা হয় না, ফলে খানাখন্দে ভরা পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারায়। রাস্তার পাশে অবৈধ দোকান কিংবা পার্কিং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। সিগন্যাল ব্যবস্থা অনেক জায়গায় অচল, কোথাওবা কার্যকর আইন প্রয়োগ নেই। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে যাত্রী, পথচারী আর চালকের মধ্যে যে শৃঙ্খলা থাকা উচিত তা ভেঙে পড়ে।
>> আরও পড়তে পারেন
দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভয়াবহ
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর হাজারো মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সরকারি হিসাবে যে সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তার চেয়েও প্রকৃত সংখ্যা বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু প্রাণহানিই নয়, বহু মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়, আয়ক্ষমতা হারানো এবং মানসিক আঘাত—সব মিলিয়ে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক যানবাহনের মালিক নিয়ম ভঙ্গ করেও দায়মুক্ত থেকে যান। তারা অনভিজ্ঞ চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামান। মুনাফার লোভে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা, সময় বাঁচাতে নিয়ম ভাঙা কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে চালককে গাড়ি চালাতে বাধ্য করা—সবই দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। অথচ এই মালিকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দুর্ঘটনার পর দায়ীদের গ্রেফতার করা হলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তারা জামিনে মুক্তি পায়। শাস্তির ভয় না থাকায় দোষীরা আবারও একই কাজ করে। কঠোর নজরদারি, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত তদারকি ছাড়া দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়।

সম্প্রতি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে-২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ৩৪ হাজার ৮৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৭ হাজার ৩৮২ জন নিহত এবং ৫৯ হাজার ৫৯৭ জন আহত হয়েছেন।
সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছরই সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে এবং দেশের জন্য এটি এক অশনি সংকেত। এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর পেছনে রয়েছে অবকাঠামোগত পরিকল্পনার অভাব, আইন প্রয়োগে শিথিলতা এবং পরিবহন ব্যবস্থার সার্বিক দুর্বলতা। দেশের সড়ক পরিবহন খাতে কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং পরিস্থিতি দিন দিন আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি।
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে বছরে গড়ে প্রায় ৫ হাজার ৭০০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন প্রায় ৮ হাজার মানুষ, আর আহত হচ্ছেন ১৪ হাজারের বেশি। দীর্ঘ এগারো বছরের (২০১৪-২০২৪) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সড়ক দুর্ঘটনার সূচক একেবারেই নিম্নমুখী হয়নি, বরং ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে।
সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে মাসে গড়ে প্রায় ৪৭৫টি দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় নিহত হচ্ছেন ৬৬৪ জন, আর আহত হচ্ছেন ১ হাজার ১৬৮ জন। প্রতিদিনের হিসেবে দেখা যায়, দেশে গড়ে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে, এতে ২২ জন প্রাণ হারান এবং অন্তত ৩৮ জন আহত হন।
বিগত এগারো বছরের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে মোট ৬২ হাজার ৭১৫টি দুর্ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। এরপর থেকে কোনো বছরে কিছুটা কমলেও আবার অন্য কোনো বছরে বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৫৯-এ।
যানবাহনভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১৪ শতাংশ ঘটেছে বাসে, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের দুর্ঘটনার হার ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
আরও পড়তে পারেন
সাড়ে ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ হাজারের বেশি নিহত
প্রাণহানির হিসাবও কম ভয়াবহ নয়। ২০১৪ সালে সড়কে নিহত হয়েছিলেন ৮ হাজার ৫৮১ জন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৪২ জন। পরের বছরগুলোতে মৃত্যুর হার কিছুটা ওঠানামা করলেও তা কাছাকাছি সীমায় ঘোরাফেরা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫৪৩ জন।
আহতের সংখ্যাও কম নয়। ২০১৪ সালে আহত হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন। পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা ওঠানামা করতে থাকে। ২০২৩ সালে আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭২ জন, আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬০৮ জনে।
সংকট কোথায়, কীভাবে মিলবে প্রতিকার
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার সব ধরনের কারণই বিদ্যমান। অথচ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর কোনো কৌশল নেই, কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। বড় সমস্যা হলো—দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলেও কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, কোনো শাস্তিও হয় না। দায়বদ্ধতার এই অভাবই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে না আসার প্রধান কারণ। তার মতে, এগুলো প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনা নয়; বরং কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও ভুক্তভোগীরা তা পান না। আবেদন প্রক্রিয়া জটিল, প্রচার সীমিত এবং বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রয়োজন অন্তত ৭০০ কোটি টাকা, অথচ দুই বছরে মাত্র ২০০ কোটি টাকা জমা হয় এবং সেই অর্থও সঠিকভাবে বিতরণ করা হয় না।
তার মতে, সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সড়ক নির্মাণ করছে, কিন্তু সেই সড়ক নিরাপদ ব্যবহারের জন্য মানুষকে সচেতন করার কোনো উদ্যোগ নেই। বরাদ্দের অভাবে জনগণ এখনো জানে না কীভাবে নিরাপদে সড়ক ব্যবহার করতে হয়। ফলে অবকাঠামো তৈরি হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সহজ সমাধান হলো রেল খাতকে উন্নয়ন করা। সড়কের চাপের অর্ধেক যদি রেলপথে স্থানান্তর করা যায়, তবে দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে, পরিবহন খরচ হ্রাস পাবে, পণ্যের সাশ্রয় হবে এবং রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ও কমে আসবে। কিন্তু এসব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানো হচ্ছে না। কারণ, সড়ক পরিবহন খাতে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সুযোগ বেশি। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে একটি গোষ্ঠী এই খাতকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছে বলেই দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মুখে মুখে আলোচনা করে সমাধান সম্ভব নয়; সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হলো কারিগরি ত্রুটি। তাই এসব ত্রুটি চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে মূলত আমলারা। যেখানে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন থাকা উচিত, সেখানে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় সবকিছু চলছে।
তার মতে, যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে প্রকৃত কারিগরি বিশেষজ্ঞরা থাকতেন, তবে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ হতো। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সরকারের কৌশলগত ব্যর্থতার কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এএইচ/জেবি

