দীর্ঘদিনের অবহেলা আর জরাজীর্ণ চেহারা কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবন এখন নতুন সাজে ধরা দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের চোখে। যদিও প্রকৃত অর্থে বড় ধরনের সংস্কার কাজ এখনও শুরু হয়নি, জুলাই মাসকে কেন্দ্র করে ভবনটিতে আংশিক সাজসজ্জা ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে।
ডাকসু ভবন একসময় ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন কিংবা সাংস্কৃতিক জাগরণ— প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে এই ভবনের ভেতরেই জন্ম নিয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আন্দোলনের পরিকল্পনা, অধিকার আদায়ের লড়াই, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড— সবই এক সময়ে এই ভবনকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু দীর্ঘ সময় নির্বাচন না হওয়া এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভবনটি প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। পরে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৯ সালের ১১ মার্চ। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি, যদিও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ নিয়মিত ফি আদায় করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সংগৃহীত এই অর্থের সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার কারণে ভবনের আসবাবপত্র ভেঙে যায়, দেয়ালে ছেঁড়া পোস্টার জমে, অনেক কক্ষ তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এবার নির্বাচনের আগে কিছুটা হলেও চেহারা বদলেছে ভবনের। জুলাই মাসকে কেন্দ্র করে দেয়ালে নতুন রঙ, করিডোর পরিষ্কার, আসবাবপত্র গোছানো, মধুর ক্যান্টিনের আশপাশে পরিচ্ছন্নতা আনা হয়। শিক্ষার্থীরাও গ্রাফিতি আঁকা ও করিডোর সাজানোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তবে এখনও অনেক জায়গায় শ্যাওলা এবং দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়তে দেখা যায়।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নওশীন আক্তার বলেন, ডাকসু ভবনের সঙ্গে আমাদের গৌরবময় অতীতের সংযোগ এখন নতুনভাবে ফুটে উঠছে। কিছু সংস্কার হয়েছে, তবে এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। আশা করি নতুন নেতৃত্বে যারা আসবেন, তারা এগুলো নিয়ে কাজ করবেন।
বিজ্ঞাপন
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রুবেল মিয়া বলেন, যেখানে একসময় আমরা হতাশা অনুভব করতাম, সেখানে এখন নতুন উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে এই প্রস্তুতি আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
সংস্কারের পাশাপাশি ভবনের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণেও নজর দেওয়া হয়েছে। দেয়ালে ম্লান হয়ে যাওয়া পোস্টার, ঝাপসা স্লোগান, পুরোনো ছবি— সবই শিক্ষার্থীদের অতীত সংগ্রামের স্মৃতি বহন করছে। প্রশাসন বলছে, সংস্কারের সময় এসব স্মৃতিচিহ্ন যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মতে, বাজেট অনুমোদনের পর ডাকসু ভবনের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার শুরু হবে। এর মধ্যে থাকবে ভাঙাচোরা আসবাবপত্র পরিবর্তন, সব কক্ষের সংস্কার, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা, আধুনিক কনফারেন্স রুম, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট স্থান এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো।

শিক্ষার্থীরা চান, ডাকসু ভবন শুধু নির্বাচনের সময় নয়, সারা বছরই তাদের মিলন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে থাকুক। তারা আশা করছেন, এই সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলে ভবনটি আবারও শিক্ষার্থীদের উদ্দীপনা, সৃজনশীলতা ও আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হবে।
তফসিল অনুযায়ী, ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। নির্বাচনের আগে ডাকসু ভবন যে নতুন প্রাণ পাচ্ছে, তা শিক্ষার্থীদের মনে নতুন প্রত্যাশা জাগাচ্ছে। অতীতের গৌরব আর বর্তমানের উদ্দীপনা মিলিয়ে এটি আবারও হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের প্রাণকেন্দ্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, জুলাই মাসে ডাকসু ভবনে কিছু সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ পান। তবে আসল সংস্কার কাজের জন্য বড় বাজেট প্রয়োজন, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা চাই, এই ভবনটি শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে নয়, বরং কার্যকারিতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার উপযোগীতায়ও সমৃদ্ধ হোক।
এইচ/এফএ

