শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাবার হাত ধরে হাঁটতে চায় ঋদ্ধি

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০২৫, ০৭:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

বাবার হাত ধরে হাঁটতে চায় ঋদ্ধি

শিশুরা যখন বাবার হাত ধরে হাঁটে, তখন পৃথিবীটা তাদের কাছে নিরাপদ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া, বাবার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়া, কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফেরার পথে বাবার হাতের উষ্ণতা— এসবই হয়ে ওঠে শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। কিন্তু ঋদ্ধির জন্য এই দৃশ্য কেবল গল্পের বইয়ের পাতায়, সিনেমার পর্দায় বা অন্যদের জীবনে দেখা এক ছবি। নিজের জীবনে সে কোনোদিন বাবার হাত ধরেনি— ধরতে পারেনি। জন্মের কয়েক মাস পরই বাবা হারিয়ে গিয়েছিলেন, আর সেই হারিয়ে যাওয়া আজও শেষ হয়নি।

শুক্রবার (২২ আগস্ট) বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে ভুক্তভোগী পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিল ঋদ্ধি। বয়স এখন পনেরো-ষোলো হবে। কালো পোশাকে, কাঁধে ঝুলে থাকা ছোট্ট ব্যাগ, হাতে বাবার একটি ফ্রেমবন্দি ছবি— চোখে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। সেই শূন্যতা শুধু গুম হওয়া প্রিয়জনের পরিবারেরাই বোঝে।


বিজ্ঞাপন


ঋদ্ধির বাবা পারভেজ হোসেন ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু তার গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি হয়ে ওঠে পরিবারের জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগ থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, কিন্তু আর ফেরা হয়নি। কেউ জানায়নি কোথায় আছেন, কেন নেওয়া হয়েছে, কিংবা তিনি বেঁচে আছেন কিনা। সেই থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘ অপেক্ষা— যার  কোনো শেষ নেই। পুলিশের তদন্তও অনেক আগেই থেমে গেছে, কিন্তু ঋদ্ধির পরিবারের অপেক্ষা থামেনি।

ঋদ্ধি ও তার ছোট ভাইয়ের কাছে ‘বাবা’ মানে কিছু বিবর্ণ ছবি, কিছু কল্পনার টুকরো আর এক অমূল্য স্মৃতি— বাবার লেখা আয়নাঘরের দেয়ালে দেখেছে ঋদ্ধি ও তার ছোট ভাইয়ের নাম উৎসর্গ করে লেখা। ছোট ভাই তো কখনো বাবার মুখই দেখেনি, শুধু ছবির ভেতর সেই মুখ কল্পনা করে। মা যখন পুরোনো অ্যালবাম বের করেন, ভাইটি ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে— এটাই কি আমাদের বাবা? মা চুপ করে থাকেন, কারণ উত্তর দেওয়ার মতো কোনো নির্দিষ্ট সত্য নেই তার কাছে।

মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধি শুনছিল অন্য ভুক্তভোগী পরিবারের কথা। কারও স্বামী, কারও বাবা, কারও ছেলে— সবাই একই যন্ত্রণার গল্প বলছে। চারপাশে কান্না আর প্রতিবাদের স্লোগান মিলেমিশে এক অদ্ভুত ভারী পরিবেশ তৈরি করেছিল। এক পর্যায়ে সঞ্চালক মাইক্রোফোন হাতে ঋদ্ধির নাম ঘোষণা করলেন। বাবার ছবি বুকে চেপে ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। দর্শকদের দৃষ্টি তখন তার দিকে নিবদ্ধ। মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিতেই কিছুক্ষণ থেমে গেল কণ্ঠ। ঠোঁট কাঁপছে, চোখে জল ভরে উঠেছে, গলা যেন আটকে গেছে।

তারপর খুব ধীর কণ্ঠে ঋদ্ধি বলল— দীর্ঘ ১৩ বছর বাবাকে দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করে, হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমরা পারি না। ছোট থেকে বড় হয়ে গেছি যুদ্ধ করতে করতে, আর কত যুদ্ধ করব? আমার ভাই জিজ্ঞাসা করে— বাবা কোথায়? মা উত্তর দিতে পারেন না। আমরা জানি না, বেঁচে আছেন কিনা কিংবা মারা গেছেন কিনা।


বিজ্ঞাপন


এই কয়েকটি বাক্য যেন পুরো প্রাঙ্গণকে স্তব্ধ করে দিল। কেউ চোখ ফিরিয়ে নিলেন, কেউ গোপনে অশ্রু মুছে নিলেন। ঋদ্ধির কণ্ঠে ছিল না কোনো রাজনৈতিক স্লোগান, ছিল না কোনো কঠিন ভাষণ— কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল হৃদয়বিদারক আর্তনাদ আর পিতার প্রতি ভালোবাসা।

এই অনুষ্ঠানে শুধু ঋদ্ধি নয়, আরও অনেক শিশু-কিশোর এসেছিল, যাদের বাবা-মা গুম হয়েছেন। কেউ কেউ বাবার শেষ ফোনকলের কথা বলছে, কেউ বলছে কিভাবে জন্মদিনের কেক কাটতে কাটতে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে। এসব গল্প শুনতে শুনতে বোঝা যায়— গুমের ঘটনা শুধু একজন মানুষকে নয়, পুরো একটি প্রজন্মকে আঘাত করে, তাদের শৈশব কেড়ে নেয়, স্বপ্ন ছিনিয়ে নেয়।

এএইচ/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর