মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

শবে বরাতে ইবাদত কবুলের শর্ত

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

শবে বরাতে ইবাদত কবুলের শর্ত

চলছে বরকতময় মাস শাবান। এই মাসকে রমজানের প্রস্তুতিমূলক মাস বলা হয়। শাবান মাসের একটি মর্যাদাপূর্ণ রাতের নাম শবে বরাত। হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত। ‘শবে বরাত’ ফারসি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। 

একাধিক সহিহ হাদিসে এ রাতের মর্যাদা প্রমাণিত। তাছাড়া এ রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বিশিষ্ট ইমামগণের নির্ভরযোগ্য বহু বক্তব্য। শবে বরাতে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ নাজিল হয়। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)


বিজ্ঞাপন


দোয়া কবুলের শর্ত
হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। সেই রাতে তিনি মুশরিক এবং অন্য ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে বাজজার: ৮০)

আরও পড়ুন: শিরকমুক্ত জীবনের গুরুত্ব ও পুরস্কার

উপরোক্ত হাদিসেই দোয়া কবুলের শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, শবে বরাতের মতো মহান রাতেও শিরক ও বিদ্বেষ পোষণকারীরা ক্ষমা পাবে না। অথচ হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, শবে বরাত ৫টি দোয়া কবুলের সময়ের একটি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যে রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।— ১. জুমার রাত। ২. রজব মাসের প্রথম রাত। ৩. শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত (শবে বরাত)। ৪. ঈদুল ফিতরের রাত। ৫. ঈদুল আজহার রাত।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক: ৭৯২৭)

সুতরাং দোয়া কবুলের রাতেও মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারীরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। তাই মন থেকে হিংসা দূর করে দিতে হবে। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরি ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফেরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ (লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬)


বিজ্ঞাপন


বিদআত বর্জনীয়
শবে বরাতের বিশেষ নিয়মে কোনো আমলের কথা কোরআন-হাদিস ও সাহাবিদের জীবনীতে কোথাও নেই। তাই নব-আবিষ্কৃত বিষয় থেকে  সতর্ক থাকতে হবে। শুধু শবে-বরাতের রাতে না, বিদআত সবসময় বর্জনীয়। বিদআতের বিরুদ্ধে মহানবী (স.) অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত সব কিছুই বিদআত। প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (সহিহ মুসলিম: ১৫৩৫; নাসায়ি: ১৫৬০)

আরও পড়ুন: বিদআতি লোককে আশ্রয়দাতার ব্যাপারেও কঠিন কথা বলেছেন নবীজি (স.)

শবে বরাতের বিশুদ্ধ আমল
শবে বরাতে নবীজির আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন—‘একবার রাসুলুল্লাহ (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসুল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। 

তখন নবী (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)

এই হাদিস থেকে এ রাতের মাহাত্ম্য জানা যায়, ইবাদত কবুলের শর্তও উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তা-ও বোঝা যায়। অর্থাৎ এ রাতে শিরক ও হিংসামুক্ত হয়ে দীর্ঘ নামাজ পড়া, সেজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া ও ইস্তেগফার করা খুবই ফজিলতপূর্ণ আমল এবং এতে ক্ষমালাভের ওয়াদা রয়েছে। 

একাকী নফল ইবাদতের গুরুত্ব
শবে বরাতের রাতে একাকি যত বেশি ইচ্ছা নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াতসহ জিকির-আজকার, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল পড়া যাবে। দলবদ্ধ হওয়া ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতেও কোনো সমস্যা নেই। রাসুলুল্লাহ (স.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন।

আয়েশা (রা.) বলেন- ‘এক রাতে হজরত রাসুল (স.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন- কি ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? আয়েশা (র.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল— আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৭৩৯) 

আরও পড়ুন: নবীজির চরিত্র সম্পর্কে আয়েশা (রা.) যা বলেছেন

আইয়ামে বিজের রোজা
শবে বরাতের বিশেষ কোনো রোজা নেই। তবে কেউ চাইলে আইয়ামে বিজের রোজা রাখতে পারেন। প্রত্যেক মাসেই আইয়ামে বিজের রোজা রাখা ফজিলতপূর্ণ আমল। প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামে বিজ’ বলা হয়। শাবান মাসেও এই রোজাগুলো রাখা সুন্নত। আবু জর ও কাতাদা ইবনে মিলহান (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (স.) আইয়ামে বিজ তথা শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখতে বলেছিলেন।’ (তিরমিজি: ৭৬১; নাসায়ি: ৪/২২৩-২২৪; ইবনে মাজাহ: ১৭০৭-১৭০৮; আবু দাউদ: ২৪৪৯) কিন্তু বিশেষভাবে শবে বরাতে রোজা রাখা সুন্নত ও মোস্তাহাব মনে করা যাবে না। 

মনে রাখতে হবে, কোনো নির্দিষ্ট তারিখে নয়, বরং পুরো শাবান মাসই নফল রোজার উপযুক্ত মাস। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী কারিম (স.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প ক’দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি: ৭৩৭)

বিশেষ দোয়া
রমজানের দুই মাস আগ থেকেই রাসুল (স.) একটি দোয়া বেশি বেশি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দোয়াটি আমরা পুরো রজব-শাবানে পড়তে পারি। দোয়াটি হলো— اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ (অর্থ) ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’  আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রজব মাস শুরু হলে রাসুল (স.) এই দোয়া পাঠ করতেন। (বায়হাকি: ৩৫৩৪; নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬) 

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শবে বরাতের মাহাত্ম্য ও ফজিলত সম্পর্কে জানার তাওফিক দান করুন। বিদআত- হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পবিত্র থাকার তাওফিক দান করুন। শাবান মাস জুড়ে নফল রোজা, দীর্ঘ নফল নামাজ, দান-সদকা, তাওবা-ইস্তেগফার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর