বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। চারিত্রিক পূর্ণতা দান ছিল রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নবুয়তের অন্যতম মিশন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, নিশ্চয়ই আমি চারিত্রিক গুণাবলি পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদে আহমদ: ৮৯৩৯) আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সুরা কলম: ০৪)
মহানবী (স.) আল্লাহর নির্দেশ পালনে এবং নানা মানবিক কারণে একাধিক বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্য, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্বশীল আচরণের কারণে সব স্ত্রীর কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয়।
বিজ্ঞাপন
স্ত্রীদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট ছিলেন আয়েশা (রা.)। তাঁকে নবীজি বিয়ে করেছিলেন আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ করে। সব ইতিহাসবিদ একমত যে, তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম মেধাবী নারী। মহানবী (স.) তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিধি-বিধান, বিশেষ করে নারীদের একান্ত বিষয়াদি উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। মূলত এটিই ছিল আল্লাহর ফায়সালা।
এ বিষয়ে আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (স.) তাঁকে বলেছেন, দুইবার তোমার চেহারা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। আমি দেখলাম, তুমি একটি রেশমি কাপড়ে আবৃতা এবং (জিবরাইল) আমাকে বলছেন, ইনি আপনার স্ত্রী, আমি ঘোমটাটা সরিয়ে দেখলাম। দেখি ওই নারী তো তুমিই। তখন আমি ভাবছিলাম, যদি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে তিনি তা বাস্তবায়িত করবেন। (বুখারি: ৩৮৯৫, ৫০৭৮, ৫১২৫, ৭০১১; মুসলিম: ২৪৩৮)
নবীজির জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর স্ত্রীদের কেউ তার প্রতি কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি; বরং মহানবী (স.)-এর স্ত্রীদের কাছে তার সান্নিধ্য ও সংশ্রবের চেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তির আর কিছু ছিল না। আয়েশা (রা.)কে নবীজির চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘জেনে রাখো! পুরো কোরআনই হলো রাসুল (সা.)-এর চরিত্র।’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল-কোরআনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমদ: ২৫৮১৩)
মহানবী (স.) তাঁর স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তাদের হাসিখুশি থাকার দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, এক সফরে তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তখন তিনি কিশোরী। রাসুল (স.) সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। অতঃপর তিনি আয়েশা (রা.)-কে বললেন, এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং দৌড়ে তার চেয়ে এগিয়ে গেলাম।’ (আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসায়ি: ৮৯৪৫)
বিজ্ঞাপন
নবীজি (স.)-এর পবিত্র দাম্পত্য জীবনে স্বীয় স্ত্রীদের সঙ্গে আন্তরিকতা ও রোমান্টিকতার এত সব চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, যা একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের উৎকৃষ্ট উপমা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে উম্মুল মুমিনিনরা এসব ঘটনার বিবরণ এতটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দিয়েছেন, যা তাদের ভেতরকার ভাব-আবেগের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করা পছন্দ করতেন’ (মুসলিম: ৩০০)। তিনি আরও বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ভালোবেসে কখনও কখনও আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ: ২৪৭৪)
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি হাড় থেকে গোশত কামড়ে নিতাম। তারপর আমি যেখানে মুখ রাখতাম আল্লাহর রাসুল (স.) সেখানে তার মুখ রাখতেন। অথচ তখন আমি ঋতুমতী ছিলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। তারপর তিনি সে স্থানে মুখ রাখতেন, যেখানে আমি মুখ রাখতাম। অথচ আমি তখন ঋতুমতী ছিলাম।’ (নাসায়ি: ৭০)
অন্য হাদিসে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ও রাসুলুল্লাহ (স.) একই পাত্র থেকে গোসল করতাম যা আমাদের মধ্যে থাকত। তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী হলে আমি বলতাম, আমার জন্য রাখুন! আমার জন্য রাখুন!’ (সহিহ মুসলিম: ৩২১)
আয়েশা (রা.) আরও বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনো প্রকার অশোভনীয় কথা বলতেন না। বাজারেও তিনি উচ্চৈসঃরে কথা বলতেন না। মন্দের প্রতিকার মন্দ দ্বারা করতেন না; বরং ক্ষমা করে দিতেন। অতঃপর কখনো তা আলোচনাও করতেন না। (শামায়েলে তিরমিজি: ২৬৫; মুসনাদে আহমদ: ২৫৪৫৬; শুআবুল ঈমান: ৭৯৪৪ সহিহ ইবনে হিব্বান: ৬৪৪৩)
তিনি হাসিমুখে বিশুদ্ধ, মার্জিত ও সুন্দরভাবে কথা বলতেন। যা দ্রুত শ্রোতাকে আকৃষ্ট করত। আর একেই লোকেরা ‘জাদু’ বলত। তাঁর উন্নত ও শুদ্ধভাষিতায় মুগ্ধ হয়েই ইয়ামেনের জেমাদ আজদি মুসলমান হয়ে যান। (মুসলিম: ৮৬৮ (৪৬); মেশকাত: ৫৮৬০)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.)-কে যখনই দুটি কাজের এখতিয়ার দেওয়া হতো, তখন তিনি সহজটি বেছে নিতেন। যদি তাতে গুনাহের কিছু না থাকত। তিনি নিজের জন্য কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু আল্লাহর জন্য হলে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়তেন না’। (বুখারি: ৬১২৬; মুসলিম: ২৩২৭; মেশকাত: ৫৮১৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়)
‘ওয়াজ-নসিহত করতেন, যতক্ষণ না মানুষ বিব্রতবোধ করে’ (বুখারি: ৬৪১১; মুসলিম: ২৮২১; মেশকাত: ২০৭)। ‘নফল সালাত চুপে চুপে আদায় করতেন, যাতে অন্যের কষ্ট না হয়। তিনি বলতেন, فَاكْلَفُوْا مِنَ الْعَمَلِ مَا تُطِيْقُوْنَ ‘তোমরা এমন আমল করো, যা তোমাদের সাধ্যে কুলায়।’ (বুখারি: ১৯৬৬ ‘সওম’ অধ্যায়-৩০)
রাসুল (স.) কখনো তাঁর স্ত্রীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করেননি। কোনো কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি চুপ হয়ে যেতেন এবং তাঁর চেহারা মোবারক লালবর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু তিনি কখনো কোনো কটু কথা বলতেন না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমি রাসুল (স.)-কে খাদেম ও কোনো স্ত্রীকে প্রহার করতে দেখিনি।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৮৬)
বিশ্বনবী (স.) ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন। এ সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী কারিম (স.) জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি কাজ করতেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৫৩৮০)
স্ত্রীদের মানসিক প্রশান্তির প্রতি খুব লক্ষ্য রাখতেন নবীজি (স.)। একবার হাবশি কিছু লোক মসজিদে নববীর সামনে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছিল, তখন রাসুল (স.) নিজের পক্ষ থেকেই হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি তাদের মহড়া দেখতে আগ্রহী? হজরত আয়েশা (রা.) হ্যাঁসূচক উত্তর দিলে রাসুল (স.) ঘরের দরজায় আয়েশাকে চাদর দিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে যান। আর আয়েশা (রা.) রাসুলের পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কাঁধ ও কান মুবারকের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা দিয়ে তাদের মহড়া দেখতে থাকেন। আয়েশা (রা.) নিজে নিজে প্রস্থান না করা পর্যন্ত রাসুল (স.) এভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। (বুখারি: ৫১৯০)
রাসুল (স.)-এর ভালোবাসায় আয়েশা (রা.) কবিতায় লেখেন ‘আমাদের একটি সূর্য আছে, আকাশেরও একটি সূর্য/আমার সূর্য আকাশের সূর্যের চেয়ে উত্তম/কেননা পৃথিবীর সূর্য ফজরের পর উদিত হয়/আমার সূর্য উদিত হয় সন্ধ্যার পর।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৮৫)
রাসুল (স.)-এর এই অনন্য চরিত্র মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান। তিনি সবসময় কামনা করতেন তাঁর প্রিয় উম্মতরা চরিত্রবান হোক। তিনি বলেন, ‘যে তার চরিত্র সুন্দর করবে আমি সর্বোত্তম জান্নাতে তার জন্য ঘরের জামিনদার হব’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮০২)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয় কেয়ামতের দিনে তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং আমার মজলিশের সবচেয়ে কাছে তারাই থাকবে যারা তোমাদের ভেতর সর্বোত্তম চরিত্রবান।’ (সুনানে তিরমিজি: ২০১৮)
মহানবী (স.)-এর গোটা জীবন সব স্তরের মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই তোমাদের প্রত্যেকের জন্য রাসুল (স.)-এর মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (সুরা আহজাব: ২১)। আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার পাশ থেকে সরে যেত (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)।
উল্লেখ্য, আয়েশা (রা.)-এর মাতা-পিতা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে মহানবী (স.)-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময়ের কোনো মুসলিম কিংবা অমুসলিম এ বিয়ের প্রতিবাদ করেনি। কারণ সে সময় মেয়েদের এ বয়সেই সাধারণত বিয়ে দেওয়া হতো। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির জন্য হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা লালন করার এবং তাঁর পবিত্র সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।