মসজিদুল আকসা, আল-কুদস, আল-আকসা মসজিদ বা বায়তুল মুকাদ্দাস। ঐতিহাসিক এই মসজিদ পবিত্র নগরী জেরুজালেমে অবস্থিত। এতে ২ টি বড় এবং ১০ টি ছোট গম্বুজ রয়েছে। এ মসজিদ নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বর্ণ, সিসা এবং মার্বেলসহ বিভিন্ন প্রকার পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। এর আয়তন সাড়ে তিন হাজার বর্গমিটার। পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন এই মসজিদে।
পবিত্র স্থাপনা
মসজিদে আকসা ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থাপনা। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, মহানবী (স.) বর্ণনা করেন, ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্যকোনো মসজিদে বিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করো না। আর সে তিনটি মসজিদ হলো— মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা।’ (সহিহ বুখারি: ১১১৫)
বিজ্ঞাপন
কিবলা
মানবজাতির প্রথমে কিবলা ‘কাবা’ শরিফ হলেও মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রিয়নবী (স.) ওহি লাভ ও নবুয়ত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসই কিবলা ছিল। নবীজি (স.) মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে পুনর্নির্ধারিত হয়। এর সাক্ষী হিসেবে মদিনা শরিফে ‘মসজিদু কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ঐতিহাসিক এ ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা বাকারা: ১৪২-১৫১)
আল-আকসা মসজিদ ও আশেপাশের স্থাপনা
বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ এ তিনটির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরিফ’ এর চার দেয়ালের মধ্যেই অবস্থিত। হারাম আশ শরিফ হলো- মসজিদে আকসার সঙ্গে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো। এসব স্থাপনাসহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আশ শরিফ বলা হয়। এছাড়াও এটি বিশ্বের কাছে ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে পরিচিতি পেয়েছে।
প্রাচীন মসজিদ আল-আকসা
পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর নির্মিত হয় আল আকসা। তাই এটিই মক্কার পর পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম নগরী। বর্তমান পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠান একে ওল্ড সিটি ঘোষণার অনেক আগেই নবীজি (স.) একে ওল্ড সিটি বা প্রাচীনতম শহরের মর্যাদা দিয়ে গেছেন। হজরত আবুজর গিফারি (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম—হে আল্লাহর রাসুল (স.)! দুনিয়াতে কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। অতঃপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের। (সহিহ বুখারি: ৩১১৫)
বিজ্ঞাপন
মসজিদে আকসা মুসলমানদের
আল-আকসা মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত আদম (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত সুলায়মান (আ.) এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের মুসলিম শাসক হজরত ওমর (রা) এবং এরপর দ্যা গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীসহ অসংখ্য বীরের নাম। উল্লেখিত কেউ ইহুদিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন না। এমনকি হজরত সুলায়মান (আ.)ও ইহুদিদের সরাসরি নবী ছিলেন না। তাই ‘জেরুজালেম তাওরাত কিংবা ইহুদিদের ভূমি’ সংক্রান্ত ইসরাইলি দাবি সম্পূর্ণ অর্থহীন। বরং মুসলমানরাই সুলায়মান (আ.)-এর যথার্থ উত্তরাধিকারী। কেননা ইসলাম সকল নবীর উপর ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া হজরত মুসা (আ.)-এর উপর তুর পাহাড়ে তাওরাত নাজিল হলেও তিনি ফিলিস্তিনে বাস করেননি এবং ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তা সম্ভবও হয়নি। এছাড়াও মহানবী (স.) বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মেরাজে গমন করার কারণে তা চূড়ান্তভাবে ইসলামেরই পবিত্র স্থান ও পুণ্যভূমি।
নির্মাণের ইতিহাস
হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান (আ.) জ্বিনদের মাধ্যমে এই পবিত্র মসজিদের পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরো বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের অধীনে আসে।
১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে।
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। ফাতেমি খিলাফতের কেন্দ্রীয় খলিফার নির্দেশে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ) গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। এরপর ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এই মুসলিম বীর জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।
অতঃপর ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ) বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন।
সংস্কারের ইতিহাস
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।
বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুজালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে।
আল-আকসার সঙ্গে অন্যান্য স্থাপনার পরিচয়
মসজিদে আকসার সঙ্গে অবস্থিত স্থাপনাগুলোও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন কুব্বাতুস সাখরা, কুব্বাতুস সিলসিলা ও কুব্বাতুন নবী। কুব্বাতুস সাখরাকে অনেকেই ভুলবশত মাসজিদুল আকসা মনে করে থাকেন। এটি আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে অবস্থিত একটি গম্বুজ। এ গম্বুজটির নিচে রয়েছে ‘সাখরা’ নামক একটি পাথর। কুব্বাতুস সাখরা উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৮৯ থেকে ৬৯১ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়।
জানা যায়, ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে নেওয়ার পর কুব্বাতুস সাখরা অগাস্টিনিয়ানদের দিয়ে দেওয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং আল-আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নাইটস টেম্পলাররা কুব্বাতুস সাখরার স্থানটিকে সুলায়মান (আ.) নির্মিত স্থাপনা বলে বিশ্বাস করত। তবে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মাসজিদুল আকসার ইবাদতের স্থানটিই নবী সুলায়মান (আ.) তৈরি করেছিলেন যা সময়ের ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
কুব্বাতুস সাখরার পূর্ব পাশে অবস্থিত একটি গম্বুজের নাম কুব্বাতুস সিলসিলা। এটি হারাম আশ শরিফের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। এটিও মসজিদ নয়। তবে এটিকে মুসল্লা বা সালাতের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উমাইয়া শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়। ক্রুসেডারদের সময় এটি একটি খ্রিষ্টান চ্যাপল হিসেবে ব্যবহার করা হত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবি (রহ) পুনরায় এটিকে সালাতের স্থানে রূপান্তর করেন। পরবর্তীতে মামলুক, উসমানীয় ও ফিলিস্তিন ভিত্তিক ওয়াকফ এই স্থাপনার সংস্কার করে।
কুব্বাতুন নবী হারাম আশ শরিফে অবস্থিত একটি গম্বুজ। এটি উসমানীয় আমলে নির্মিত হয়। ১৫৩৮ সালে জেরুজালেমের উসমানীয় গভর্নর মুহাম্মদ বে এই গম্বুজ নির্মাণ করেন। ১৬২০ সালে তৎকালীন গভর্নর ফারুক বে তা পুনরায় সংস্কার করেন। কুব্বাতুন নবী স্থাপনাটি অষ্টভুজাকার এবং এর আটটি স্তম্ভ ধূসর মার্বেলে নির্মিত। এটি প্রিয়নবী (স.)-এর স্মরণে নির্মিত হয়েছে। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ)সহ বেশকিছু গবেষকদের মতে, এই স্থানে প্রিয়নবী (স.) অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাদের নিয়ে মেরাজের রাতে সালাত আদায় করেছিলেন।
ইবনে তাহমিয়ার মতে, সুলায়মান (আ.)-এর তৈরি স্থাপনার সম্পূর্ণ স্থানটির নামই হল আল মসজিদুল আকসা। এই মসজিদ নির্মাণের পর থেকে ঈসা (আ.)-সহ অনেক নবীর দ্বারা আল্লাহর ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। হিজরতের পর বায়তুল্লাহ নতুন কিবলা হয়।
নবী-রাসুলদের স্মৃতি বিজড়িত
ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে মুসলমানদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হজরত ইবরাহিম ও মুসা (আ.)-সহ অসংখ্য নবী-রাসুল। এখানেই মহানবী (স.) সব নবী-রাসুল এবং ফেরেশতাদের নিয়ে নামাজ পড়ছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন স্বয়ং নবীজি (স.)। এখান থেকেই তিনি বোরাকে করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্ব-যাত্রা করছিলেন। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিককে আমি বরকতময় করেছি, যেন তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১)
আরও পড়ুন: মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময় (প্রথম পর্ব)
মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময় (শেষ পর্ব)
মসজিদে আকসায় নামাজের ফজিলত
হজরত সুলায়মান (আ.) যখন এই মসজিদ নির্মাণ শেষ করেছিলেন, তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, যে ব্যক্তি কেবলমাত্র নামাজের উদ্দেশ্যেই ওই মসজিদে উপস্থিত হবে, সে ব্যক্তি যেন ওই দিনকার মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। (নাসায়ি: ৬৬৯, ইবনে মাজাহ: ১৪০৮)
উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামাহ (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদে হারামে হজ কিংবা ওমরা পালনে গমন করবে তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে কিংবা তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৪৭৯)
মায়মুনা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল (স.)-কে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে কিছু বলুন!’ রাসুল (স.) বললেন, ‘বায়তুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা তাতে গিয়ে সালাত আদায় করো। কেননা, তাতে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা অন্যান্য মসজিদে এক হাজার সালাত আদায়ের সওয়ার পাওয়া যায়..।” (মুসনাদে আহমদ: ২৬৩৪৩)
মসজিদে আকসা নিয়ে ইহুদিদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড
ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ভৌগোলিক দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত হওয়ায় এ স্থান দখলের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে ইহুদি-খ্রিস্টানরা। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানের সঙ্গে তাদের ধর্মের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এটি আয়ত্তের জন্য ধর্মগ্রন্থ বিকৃত করে হলেও তা অধিকারের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে।
বর্তমানে ইহুদিবাদি ইসরাইল ঐতিহাসিক এই মসজিদটি দখল করে রেখেছে। ১৯৬৯ সালে তারা একবার আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল। বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরাইলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় বাঁধাও দেওয়া হয়।
এই বিধি-নিষেধের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন করা হয়। কখনো শুধু জুমুআর সালাতের সময় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। ইসরাইল সরকার দাবি করে- নিরাপত্তার কারণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
আরও পড়ুন: জমজম কূপ: আল্লাহর এক বিস্ময়কর নিদর্শন
জাতিসংঘের ভুল সিদ্ধান্ত
১৯১৭ সালে জেরুজালেম ব্রিটেনের দখলে চলে যাওয়ার সময় এখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। শুরু হয় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে দখলদার ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করতে থাকে এবং ১০ শতাংশ জমির মালিক হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। আর ব্রিটেন ব্যাপারটি কৌশলে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ১০ শতাংশ জমির মালিকদের জন্য গোটা ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি বরাদ্দ করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘ ইহুদিদের শুধু ফিলিস্তিনিদের জায়গা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মুসলিম-বিরোধী ভয়ংকর এক নির্দেশনা দেয়। মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানায় থাকা আল আকসাসহ জেরুজালেমের অধিকার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কাউকেই না দিয়ে এর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা করে জাতিসংঘ। এতে ইসরায়েল খুবই খুশি হয়। কারণ, তা তো মূলত মুসলমানদের জায়গা। আপাতত আল আকসা ও জেরুজালেমের প্রকৃত মালিকদের নিরঙ্কুশ মালিকানার বিষয়টি প্রতিহত করা গেল। তবে এ ঘোষণার সময় জাতিসংঘের আইনে আল আকসা ও জেরুজালেমের মালিকানা এককভাবে ফিলিস্তিনিদের হাতে না থাকলেও তার বাস্তব নিয়ন্ত্রণ এককভাবে মুসলমানদের হাতেই ছিল। আল আকসায় কোনো ইহুদি প্রবেশ করতে পারত না। তা ছিল শুধুই মুসলমানদের। কিন্তু ইতিহাসে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত ১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল, মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার মধ্যকার যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয়। এর মধ্য দিয়ে পুরো জেরুজালেমে বাস্তব নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠা করে ইসরায়েল। পুরো আল আকসার একাংশকে তাদের ধর্মের পবিত্র স্থান ঘোষণা করে।
ইহুদিদের আইন-লঙ্ঘন
জেরুজালেমে ইহুদি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও আইন লঙ্ঘন করেই জেরুজালেমে ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। তবে আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রই জেরুজালেমে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেয়নি। সব রাষ্ট্রই এর বিরোধিতা করে আসছে। এমনকি জেরুজালেমের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে চলে গেলেও এখনো মসজিদে আকসার সার্বিক পরিচালনা ফিলিস্তিনের নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামি ওয়াকফের’ তত্ত্বাবধানেই রয়েছে।
জাতিসংঘ যখন দেখল যে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ক্রমেই আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করছে, তখন তারাও তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে। জেরুজালেমে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ। জেরুজালেম ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণার ব্যাপারটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪৭৮ নম্বর প্রস্তাব দ্বারা বাতিল করা হয়। অন্যদিকে আল আকসায় ইহুদিদের ‘পবিত্র স্থান’ ঘোষণাকে নাকচ করে মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানার কথা ঘোষণা করে।
আল-আকসায় ইহুদিদের অধিকার নেই বলে ইউনেসকোর ঘোষণা
২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তাদের ভোটাভুটির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে মসজিদে আকসা কেবলই মুসলমানদের। এতে ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই। তাদের অধিকার না থাকায়ও তারা যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, ইউনেসকো তারও প্রতিবাদ জানায়। সুতরাং আল আকসা ও জেরুজালেম সব আইনের ভিত্তিতেই শুধু মুসলমানদের। এতে ইহুদিদের কোনো অধিকার নেই।