রোববার, ৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময়

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময়

ইতিহাসে মহাবিস্ময়কর বাস্তবতার নাম মেরাজে রাসুল (স.)। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এ অলৌকিক ঘটনার আলোকপাত করেন এভাবে-

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ


বিজ্ঞাপন


পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (মুহাম্মাদ স.) রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ১)

পবিত্র কোরআনে ঘোষিত এ মেরাজই লাইলাতুল মেরাজ বা শবে মেরাজ। লাইলাতুন বা শব অর্থ হলো- রাত আর মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজের অর্থ দাঁড়ায়- ঊর্ধ্বগমনের রাত।  ‘রজবের’ ২৭ তারিখ নবুওয়ের দশম বর্ষে নবী করিম (স.)-এর ৫০ বছর বয়সে পবিত্র মেরাজ সংঘটিত হয় (সূত্র: সিরাতে মোস্তফা: আশেকে এলাহি মিরাঠি, ও তারিখুল ইসলাম: মাওলানা হিফজুর রহমান সিহারভি)। 

মেরাজের ঘটনায় দুটো অংশ ছিল। এক. আল-ইসরা বা জেরুজালেমে নৈশ-ভ্রমণ এবং দুই. মেরাজ বা ঊর্ধ্বারোহণ বা স্বর্গারোহণ। আল্লাহ তাআলার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে পবিত্র কাবা হতে ভূ-মধ্যসাগরের পূর্ব তীর ফিলিস্তিনে অবস্থিত পবিত্র বায়তুল আকসায় যান। সেখান থেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে উর্ধ্ব জগতের রওনা হন। সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে আরশে আজিমে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) মহান আল্লাহ তাআলার দিদার লাভ করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন।

এই ভ্রমণে তাঁর দৃষ্টির সামনে উপস্থাপন করা হয় সৃষ্টি জগতের অপার রহস্য। স্বচক্ষে বেহেশত-দোজখ অবলোকন, পূর্ববর্তী নবী-রসুলদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরিচিতি, সুবিশাল নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ, মহাকাশ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম প্রভৃতি সামনাসামনি দেখা, সর্বোপরি মহান রবের সঙ্গে পবিত্র দিদারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে পরম সৌভাগ্যমণ্ডিত করেন। এতে সৃষ্টিজগতের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাইয়েদুল আম্বিয়া হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর সুমহান মর্যাদা। ইসরা ও মিরাজের এ ঘটনায় একদিকে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনা, অন্যদিকে সেখানে লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইলাহি হেকমত ও রহস্য।


বিজ্ঞাপন


কোরআন-হাদিস দ্বারা নিশ্চিত প্রমাণিত বিষয়টি নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া মুমিনের কর্তব্য। মহানবী (স.)-এর সীরাতের সঙ্গে সম্পর্কিত এই মহাঅলৌকিক ঘটনা ইসলামী আক্বীদা ও বিশ্বাসের অংশ। এই ঘটনা কুরআনেও আছে, সহিহ হাদিসেও আছে। কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে তার ঈমান থাকবে না। যুক্তি বা বিজ্ঞান এটাকে স্বীকার করুক আর না করুক, মুমিন মুসলমানকে বিশ্বাস করতেই হবে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মেরাজ শোনামাত্রই বিশ্বাস করেছিলেন হজরত আবু বকর (রা.), আর আবু জাহেল ও তাঁর সঙ্গীরা করেছিল বাড়াবাড়ি। মহান আল্লাহ দীর্ঘ ভাষায় কাফেরদের বাড়াবাড়ির জবাব দেন।

‘সহজাত শক্তিসম্পন্ন, (জিব্রাইল আ.) নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল। ঊর্ধ্ব দিগন্তে, অতঃপর নিকটবর্তী হল ও ঝুলে গেল। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম। রাসুলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে। তোমরা কি সেই বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে?’। (সুরা নাজম: ৬-১২)

ইসরার ঘটনা

হিজরতের আগের কথা। কাফির-মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ আর অকথ্য নির্যাতনের সময়ে এক রাতে নবীজি (স.) সাহাবিদের নিয়ে এশার নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর খানায়ে কাবা সংলগ্ন ‘হাতিমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। তন্দ্রাবিষ্ট অবস্থায় জিব্রাইল (আ.) নেমে এলেন। নবীজিকে জাগ্রত করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে গেলেন আবে জমজমের কাছে। তাঁর বক্ষের অগ্রভাগ হতে চুল পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হল। বের করা হল তাঁর হৃৎপিণ্ড। এরপর তা আবে জমজম দ্বারা শোধন করা হল। ঈমান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর স্বর্ণের একটি পেয়ালা এনে তা দিয়ে ভরে দেওয়া হল নবীজির বক্ষ মুবারক। অতঃপর হৃৎপিণ্ড যথাস্থানে রেখে দিয়ে উপরিভাগ সেলাই করে দেয়া হল। হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি এর চিহ্ন নবীজির বুকে প্রত্যক্ষ করেছি।

বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন—

‘রজবের ২৭ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিব্রাইল (আ.) একটি সাদা রঙের ‘বোরাক’ নিয়ে উপস্থিত হলেন। (বোরাক হচ্ছে সাদা রঙের এক প্রকার আরোহনের যন্ত্র, সে প্রতিটি কদম ফেলে দৃষ্টির শেষ সীমানায়) রাসুল (স.) বলেন, আমি এতে আরোহন করলাম, অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দুরাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিব্রাইল (আ.) একটি শরাব এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন।’ (মুসলিম: ১ম.পৃ.৯১)

‘বুরাক’ নামক ক্ষিপ্রগতির সওয়ারীটি ছিল গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে ছোট এবং দীর্ঘদেহী। রং ছিল শুভ্র। তার চলার গতি এমনই ক্ষিপ্র ছিল যে, দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর। তার পিঠের উপর জিন আঁটা ছিল, মুখে ছিল লাগাম। নবীজি রেকাবে পা রাখবেন, এমন সময় ‘বুরাক’ ঔদ্ধত্য দেখাল। জিব্রাইল (আ.) তাকে থামিয়ে বললেন, হে বুরাক! তুমি মুহাম্মাদ (স.)-এর সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জানো, আল্লাহর কাছে তার চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনও তোমার উপর সওয়ার হয়নি? একথা শুনতেই বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (তিরমিজি: ৩১৩১)

অতঃপর নবীজি (স.) বুরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তেই জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মাকদিসে উপস্থিত। জিব্রাইল (আ.) একটি পাথর ছিদ্র করে বুরাককে বেঁধে রাখলেন। (প্রাগুক্ত: ৩১৩২)

এটা সেই বৃত্ত, যেখানে নবীগণও নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। (মুসনাদে আহমদ ২/৫২৮)

বায়তুল মাকদিসে ঢুকে তিনি দেখেন, হজরত মুসা (আ.) নামাজরত। তিনি ছিলেন ছিপছিপে ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো, যা কান পর্যন্ত ঝুলন্ত ছিল। দেখে মনে হবে যেন ‘শানওয়া’ গোত্রেরই একজন লোক। হযরত ঈসা (আ.)-কেও দণ্ডায়মান হয়ে নামাজ পড়তে দেখা গেল। তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের, সাদা ও লাল রঙবিশিষ্ট। তাঁর চুল ছিল সোজা ও চাকচিক্যময়। তাঁর আকার-আকৃতি সাহাবি উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী (রা.)-এর সাথে অধিক মেলে। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কেও নামাজরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হলো। নবীজি বলেন, তাঁর দেহাবয়ব আমার সঙ্গে অধিক সামঞ্জ্যশীল। (মুসলিম:১৬৭)

ইতোমধ্যে জামাত প্রস্তুত হল। তিনি দুরাকাত নামাজ আদায় করলেন। সকল নবী-রাসুলগণ নবীজির পেছনে ইক্তেদা করলেন। ওখান থেকে বের হয়েই দেখলেন, জিব্রাইল (আ.)-এর হাতে দুটি সুদৃশ্য পাত্র। একটি শরাবের, অপরটি দুধের । পাত্রদুটি পেশ করা হলে নবীজি (স.) দুধেরটি বেছে নিলেন। জিব্রাইল (আ.) তাঁকে বললেন, আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত ফিতরাতকেই বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি শরাব পছন্দ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। (প্রাগুক্ত: ১৬৮)

(দ্বিতীয় পর্বে শেষ হবে)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর