শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময় (শেষ পর্ব)

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

মেরাজুন্নবী: ইতিহাসের মহাবিস্ময় (শেষ পর্ব)

ঊর্ধ্বজগতের সফর

ইসরার পর্ব শেষে শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। মহানবী (স.) বুরাকের উপরই ছিলেন। একে একে প্রতি আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হল। দুনিয়ার নিকটবর্তী প্রথম আসমানে এসে জিব্রাইল (আ.) দরজা উন্মুক্ত করতে অনুরোধ করেন। অপর প্রান্ত হতে প্রশ্ন শোনা যায়, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিব্রাইল। প্রশ্ন করা হয়, আপনার সঙ্গে কে? বললেন, মুহাম্মদ। প্রশ্ন হয়, আপনি কি তাঁর কাছে প্রেরিত হয়েছেন? বললেন, হ্যাঁ।


বিজ্ঞাপন


অতঃপর প্রথম আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়। তাঁরা উপরে উঠে আসেন। নবীজি (স.) বলেন, ওখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার ডানদিকে দেখা গেল রূহের একটি ঝাঁক, বামদিকে আরেক ঝাঁক। ওই ব্যক্তি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বামদিকে তাকালে কাঁদেন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, মারহাবা হে মহান পুত্র! মারহাবা হে মহান নবী!

নবীজি (স.) জিব্রাইলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? জিব্রাইল বললেন, তিনি আদম (আ.)। তাঁর ডান ও বামদিকে যাদের দেখলেন তারা তাঁর আওলাদ। জান্নাতিরা ডানদিকে; আর বামদিকেরগুলো দোজখি। তাই তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (বুখারি: ৩৪৯)

এরপর জিব্রাইল (আ.) নবীজিকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশের পানে ছুটলেন। সেখানেও দরজা উন্মুক্ত করতে বলা হলে জিজ্ঞাসা করা হল, কে? তিনি জবাব দিলেন, জিব্রাইল। প্রশ্ন করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মদ। আবার প্রশ্ন হল, তিনি কি আহূত হয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাঁকে আনার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। দরজা খুলে দেওয়া হলে সেখানে দু’খালাত ভাই অর্থাৎ হজরত ঈসা (আ.) ও ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তাঁরা উভয়ই নবীজিকে মারহাবা বলে দোয়া করলেন। এরপর জিব্রাইল তাঁকে তৃতীয় আকাশে নিয়ে গিয়ে আগের মতো প্রশ্নোত্তর পর্বের পর দরজা খুলে দেওয়া হলে সেখানে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে মোলাকাত হল। আল্লাহ তাআলা তাঁকে গোটা রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেকটাই দান করেছিলেন। তিনিও নবীজিকে মারহাবা বলে উষ্ণ অভিবাদন জানালেন।

একই পদ্ধতিতে চতুর্থ আকাশে পৌঁছালে সেখানে হজরত ইদরিস (আ.)-এর সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। নবীজি (স.) বলেন, আমরা যখন সেখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন হজরত মুসা (আ.) ক্রন্দন করতে লাগলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এই যুবক আমার পরে প্রেরিত হয়েছে। তদুপরি তাঁর উম্মত আমার উম্মতের চেয়েও অনেক বেশি জান্নাতে যাবে। একথা ভেবেই আমি কাঁদছি।


বিজ্ঞাপন


সেখান থেকে নবীজিকে সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে দেখলেন, তখন তিনি বায়তুল মামুরে ঠেস দিয়ে উপবিষ্ট অবস্থায়। বায়তুল মা‘মুর সেই স্থান, যেখানে প্রত্যহ এমন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদত করেন, যাদের পালা আর কখনও আসে না।

হজরত ইব্রাহিমও (আ.) নবীজিকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। অতঃপর তিনি নবীজিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মুহাম্মদ! আপনার উম্মতকে আমার সালাম বলুন এবং তাদেরকে অবগত করুন যে, জান্নাতের মাটি পবিত্র, এর পানি সুমিষ্ট। জান্নাত হচ্ছে খুব পরিচ্ছন্ন ও সমতল। এর বৃক্ষ হচ্ছে-

سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله، الله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله العلى العظيم. (তিরমিজি: ৩৪৬২)

অতঃপর নবী কারিম (স.)-কে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। পৃথিবী থেকে যেসকল বস্তু অথবা রূহ উপরে আরোহণ করে, সেগুলো এখানে পৌঁছে থেমে যায়। তদ্রুপ ঊর্ধ্বজগৎ থেকে নিচে আগমনকারী সবকিছু এখানে এসে থেমে যায়। নবীজি (স.) বলেন—

সিদরাতুল মুনতাহার পাতা ছিল হাতির কানের মতো, আর ফল ছিল বড় মটকার মতো। সে এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হল। কোনো মানুষের সাধ্য নেই, সে সৌন্দর্য বর্ণনা করার। নবীজি (স.) বলেন, সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে এত ঊর্ধ্বে পৌঁছে যাই, যেখান থেকে আমি আল্লাহর হুকুম-আহকাম লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ফেরেশতাদের ‘কলমের’ আওয়াজ শুনতে পেলাম।

অতঃপর, আল্লাহ নবীজিকে যা দেওয়ার, তা দিলেন। তিনি দিনরাত্রিতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করলেন। ফিরে আসতে হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার রব আপনার উম্মতের উপর কী ফরজ করেছেন? নবীজি (স.) বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ। তিনি বললেন, আপনি মহান রবের কাছে ফিরে যান এবং আরও কমিয়ে দেওয়ার আবেদন করুন। এতটুকু পালনের সাধ্য আপনার উম্মতের নেই। আমি তো বনী ইসরাঈলকে এর চেয়ে অনেক কম ফরজ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। নবীজি ফের মহান রবের কাছে ফিরে গেলেন এবং বললেন, রাব্বুল আলামিন! আমার উম্মতের জন্য নামাজ আরও হ্রাস করুন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে দিলেন। ফিরে আসার সময় পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত নামাজের কথা হযরত মুসা (আ.)-কে জানালে তিনি বললেন, আপনার উম্মতের এতটুকু পালন করার সামর্থ্য নেই। অতএব আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। নবীজি বললেন, আমি এমনিভাবে বারবার আপন রব ও মুসা (আ.)-এর কাছে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। আর প্রতিবারই পাঁচ-পাঁচ করে কমতে থাকল। অবশেষে আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন—

মুহাম্মদ! দিন-রাত মিলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মাত্র। প্রত্যেক নামাজের জন্য দশ নামাজের সওয়াব, ফলে সেই পঞ্চাশ নামাজই হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সৎকাজের ইচ্ছা করবে, এরপর তা আমলে পরিণত করবে না, তার জন্যও একটি নেকি লেখা হবে। আর যে ইচ্ছা করার পর আমলেও পরিণত করবে, সে দশটি নেকি পাবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি মন্দ কর্মের কেবল ইচ্ছা করে, আমলে পরিণত করে না, তার কোনো গুনাহ লেখা হবে না। আর যদি আমলেও পরিণত করে, তবে মাত্র একটি গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে।

নবীজি (স.) বলেন, এরপর আমি নেমে এসে হযরত মুসা (আ.)-এর কাছে গেলাম। তাঁকে সবকিছু অবগত করলে তিনি বললেন, আপনার রবের কাছে গিয়ে আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। আমি বললাম, মহান প্রভুর কাছে অনেকবার গিয়েছি, আবেদন করেছি। এখন আমার লজ্জা হচ্ছে। অবশেষে জান্নাত, জাহান্নাম ও সপ্তাকাশের দীর্ঘ সফর করে মহান মাওলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়ে নবীজি (স.) ফিরে এলেন মক্কায়। এ পবিত্র রজনীতে মুসলমানদের জন্য তিনি তিনটি বিষয় হাদিয়াস্বরূপ নিয়ে এসেছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সুরা বাকারার শেষ আয়াতসমূহ এবং পুরো উম্মতের মধ্যে শিরক থেকে আত্মরক্ষাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত ও ক্ষমার ঘোষণা। এ ছিল উম্মতে মুহাম্মদির জন্য মিরাজের পুরস্কার। (মুসলিম: ২৭৯)

মেরাজ সম্পর্কে কিছু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা

১। এ রাতে নবীজি (স.) জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজিকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান। (মুসলিম: ১৬৫)

২। তিনি দাজ্জালকেও দেখেছিলেন। (প্রাগুক্ত)

৩। এমন এক দল লোকের পাশ দিয়ে নবীজি গমন করেছিলেন, যাদের নখ ছিল তামার। এই নখ দ্বারা তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষ আচঁড়াচ্ছিল। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জিব্রাইল (আ.) নবীজিকে জানালেন, এরা সেই লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত। অর্থাৎ একে অপরের গীবত ও মানহানি করত। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, বরং দুনিয়াতে গীবতকারী এসব লোকদেরকে মৃত ভক্ষণ করতে দেখেছিলেন নবীজি। (আহমদ ৩/২২৪)

৪। মহান এই রাতে নবীজি (স.) এমন কিছু লোককে দেখতে পেয়েছিলেন, যাদের ঠোঁট কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল, ঠোঁট কাটামাত্র তা পুনরায় জোড়া লেগে আগের মতো হয়ে যেত। এদের সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জিব্রাইল (আ.) নবীজিকে (স.) উত্তর দিলেন, এরা এমন বিষয়ে বক্তৃতা ও ওয়াজ করত, যা তারা নিজেরা আমল করত না। (প্রাগুক্ত ৩/১৮১)

৫। শবে মেরাজে নবীজি এমন লোকদের দেখলেন, যাদের পেট ছিল একেকটি গৃহের মতো। পেটের ভেতরটা সাপে ভর্তি, যা বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। প্রশ্ন করা হলে জিব্রাইল জানালেন, এরা সুদখোর। (প্রাগুক্ত ২/৩৫৩)

৬। মহানবী (স.) জান্নাত দেখার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন। (তিরমিজি: ৩১৪৭)

৭। মোতি জমরদের প্রাসাদে ঘেরা একটি নহর দেখতে পেলেন, যার পানি ছিল মেশকের চেয়ে বেশি সুগন্ধিময়। এটা কী জানতে চাইলে নবীজিকে জিব্রাইল (আ.) বললেন, এর নাম ‘কাওসার’, যা আপনার প্রতিপালক একমাত্র আপনার জন্যই সুরক্ষিত রেখেছেন।

৮। মহানবী (স.) চারটি নদীও দেখেছিলেন। এর মধ্যে দুটি জাহেরি আর দুটি বাতেনি। বাতেনি দুটি জান্নাতে প্রবাহিত আর জাহেরি দুটি হচ্ছে নীল ও ফোরাত।

৯। নবীজি (স.) জান্নাতে প্রবেশ করে একপাশে একটি হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের আওয়াজ? জিব্রাইল (আ.) বললেন, মুয়াজজিন বেলালের কণ্ঠ। মেরাজ থেকে ফিরে নবীজি সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, বেলাল সাফল্য অর্জন করেছে, আমি তার জন্য এমন সব মর্তবা দেখেছি। (আহমাদ ১/২৫৭)

১০। শবে মিরাজে নবীজি এক পবিত্র খোশবুর কাছ দিয়ে গেলেন। তিনি সুধালেন, এটা কিসের খোশবু? ফেরেশতারা বললেন, এটা ফেরাউন-তনয়ার কেশ বিন্যাসকারিনী ও তার সন্তানদের খোশবু। কোনো একদিন চুল আচঁড়াতে গিয়ে তার হাত থেকে চিরুনী পড়ে গেলে সে ‘বিসমিল্লাহ’ বলেছিল। ফেরাউন-তনয়া বিসমিল্লাহর অর্থ জানতে চেয়ে বলল, সে কি আমার পিতা? মহিলা বলল, আমার রব তিনি, যিনি আপনার ও আপনার পিতার প্রতিপালক। ফেরাউন-তনয়া বলল, আমার পিতা ছাড়া কি তোমার অন্য কোনো রবও আছে? মহিলা বলল, হ্যাঁ। এ খবর ফেরাউনের কানে গেলে সে মহিলাকে ডেকে বলল, আমি ছাড়া তোর আরও রব আছে? সে বলল, হ্যাঁ, আমার ও আপনার প্রতিপালক তো মহান আল্লাহ তাআলা। শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ফিরাউন তামায় নির্মিত একটি বড় পাত্রে তেল ভরে খুব গরম করার আদেশ দিল। ওই মহিলা ও তার সন্তানদের এতে নিক্ষেপের হুকুম হল। ফিরাউনের লোকেরা এক এক করে সবাইকে তাতে নিক্ষেপ করতে লাগল। সবার শেষে মায়ের কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশুটির পালা এল। ছোট্ট শিশু মুখ ফুটে মাকে অভয় দিল। বলে উঠল, মা নেমে পড়ো, পিছপা হয়ো না। আখিরাতের আজাবের তুলনায় দুনিয়ার আজাব তো অতি তুচ্ছ। (প্রাগুক্ত ১/৩০৯-৩১০)

১১। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবী কারিম (স.) বায়তুল মাকদিসে যাওয়া বা আসার পথে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাও দেখতে পেয়েছিলেন। (মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা: ৩২৩৫৭)

১২। শবে মেরাজের সকাল বেলা। নবীজি হাতীমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাত্রে সংঘটিত মিরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক ঠাওরাবে না তো? ইতোমধ্যে কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জাহল। নবীজির কাছে বসে বিদ্রুপের ছলে বলল—

কোনো ব্যাপার আছে নাকি? নবীজি বললেন, হ্যাঁ। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মেরাজ হয়েছে। সে বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল? নবীজি (স.) উত্তর দিলেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত। সে আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। এরপর আবু জাহল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি, তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজি আরও সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই। আবু জাহল লুয়াই ইবনে কা‘ব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সকলে এসে উপস্থিত হলে আবু জাহল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে, তা এদের কাছেও ব্যক্ত করতে পারবে? নবীজি পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিল। তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল। (তিরমিজি: ৩৪৬২)

১২। নবীজি (স.) বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তা হচ্ছিল। আমি তখন কাবার হাতীমে পুরো কওমের সামনে দণ্ডায়মান, ইতিমধ্যেই পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হল। আকীলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মাকদিস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিসংকোচে বলতে লাগলাম। শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে।

মক্কার কোনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.)। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলে সুধাল, তবুও কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে? হজরত আবু বকর (রা.) আকাশসম আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও দূরের ও জটিল বিষয়ে তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানি বার্তাসমূহের উপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। অতএব...(মুসতাদরাক ২/৩৬১)

মেরাজের শিক্ষা

মেরাজ থেকে ফিরে রাসুলুল্লাহ (স.) সুরা বনি ইসরাইলের মাধ্যমে ১৪টি প্রশিক্ষণ উম্মতের সামনে পেশ করেন-

১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। আর তোমরা কেবল আল্লাহরই বন্দেগি করো।

২. মা-বাবার সাথে উত্তম ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হয়, তাহলে তাদের সাথে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না। তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বলো। আর তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে বিনয়ী থেকো আর বলো ‘হে আমার প্রতিপালক, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন শৈশবে তারা আমাদের লালন-পালন করেছেন।’

৩. তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের মনের খবর জানেন।

৪. আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দান কর আর অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের হক আদায় কর।

৫.অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।

৬. হকদারদের হক আদায়ে অপারগ হলে তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো।

৭. একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না, আবার একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।

৮. দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা কোরো না। কারণ তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহাপাপ ।

৯. জেনা-ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চই এটি নিকৃষ্ট কাজ ও মন্দ পথ।

১০. কোনো জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা কোরো না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি এই অধিকার দিয়েছি, তবে সে যেন প্রতিশোধের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে।

১১. এতিমের সম্পদের ধারে কাছেও যেয়ো না। সম্পদের ব্যাপারে তার বয়োপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করো আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

১২. ওজনে কম দিয়ো না। সঠিকভাবে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ।

১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সেগুলোর পেছনে লেগো না। নিশ্চয়ই চোখ, কান, অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।

১৪. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনওই পর্বতসম হতে পারবে না। এগুলো সবই মন্দ ও ঘৃণিত কাজ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩-৩৮)।

ইতিহাসের মহাবিস্ময় মেরাজুন্নবী (স.) মুসলিম জাতির জন্য অনন্য উপহার। এই উপহারের মাধ্যমে প্রিয়নবী (স.) ও তাঁর উম্মতকে আল্লাহ তাআলা সর্বোচ্চ সম্মানিত করেছেন। আরশ থেকে তোহফা পাঠিয়েছেন নামাজ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই উপহারের যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দিন। আমিন।

এমএ/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর