মহাবিশ্বের আয়ু একদিন ফুরিয়ে যাবে। নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডলের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা শুধু এই অপেক্ষাই করছে যে কেয়ামত অকস্মাৎ তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুত কেয়ামতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে। সুতরাং কেয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’ (সুরা মুহাম্মদ: ১৮)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা আম্বিয়া: ১)
আরবি কিয়াম শব্দ থেকে কেয়ামত। এর অর্থ উঠে দাঁড়ানো। ইসলামি আকিদা অনুসাররে ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে কেয়ামত শুরু হবে। মানুষের অবাধ্যতা যখন চরমে পৌঁছবে, আল্লাহর নাম নেওয়ার মতো পৃথিবীতে একটি লোকও থাকবে না, সেদিন আল্লাহ এই বিশ্বজগৎ এবং সবকিছু ধ্বংস করে দেবেন। একেই বলে কেয়ামত। বিশুদ্ধ বর্ণনামতে, ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় দু’বার ফুঁ দেবেন। (সুরা জুমার: ৬৮) প্রথম ফুঁৎকারে আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু মরে যাবে, আকাশ ও সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যত জীবের সৃষ্টি হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
কাজেই মানুষের একনিষ্ঠ কর্তব্য হলো- মৃত্যু আসার আগেই বেশি বেশি উত্তম ও সৎকাজ করা। সত্যিকারের জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তো তারাই, যারা বিচার দিবসকে স্মরণ রাখে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘..যারা মৃত্যুকে বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তারাই সর্বাধিক বুদ্ধিমান।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৫৯)
কোরআন-হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনায় ও বুজুর্গদের আলোচনায় কেয়ামতের ভয়াবহতা ও বিভীষিকাময় অবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতালের মতো, অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুতঃ আল্লাহর শাস্তি বড় কঠিন।’ (সুরা হজ: ২)
‘যদি তোমরা নবীর কথা না মানো, তাহলে কেমন করে রক্ষা পাবে সেদিনের বিপদ থেকে, যা বাচ্চাদেরকে বুড়া করে দেবে এবং যার প্রচণ্ডতায় আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে?’ (সুরা মুজজাম্মিল: ১৭–১৮)
‘সেদিন মানুষ নিজের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর সেদিন এমন বিপদ নেমে আসবে যে- তখন নিজেকে ছাড়া আর কারও দিকে তাকানোর মতো অবস্থা থাকবে না’ (সুরা আবাসা: ৩৪-৩৭)
সেদিন আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে তারা সবাই বেহুঁশ হয়ে পড়বে, যাদের আল্লাহ ইচ্ছে করেন তারা ছাড়া।’ (সুরা জুমার: ৬৮)
যখন কেয়ামত শুরু হবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, দুজন ব্যক্তি কেনাবেচার জন্য কাপড় মেলে ধরবে, কিন্তু ‘তা ভাঁজ করা ও লেনদেন শেষ করার আগেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। কেউ তার উটের দুধ দহন করে বাড়ি ফিরে আসবে, কিন্তু ‘তা পান করার আগেই কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। কেউ নিজের পশুগুলোকে পানি পান করানোর জন্য জলাধার ভর্তি করবে এবং তখনো পানি পান করানো শুরু করবে না তার আগেই কেয়ামত হয়ে যাবে। কেউ খাবার খেতে বসবে এবং এক গ্রাস খাবার মুখ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযোগও পাবে না; প্রত্যেকেই যে যেখানে থাকবে সেখানেই মূর্ছা যাবে ও তাৎক্ষণিক মারা যাবে। এ সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদিসের সারমর্ম হলো—কেয়ামতের দিনটি খুবই ভয়ংকর হবে।
এক হাদিসে নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামত অবশ্যই কায়েম হবে। তা এমন সময় যে, কাপড়ের দোকানে ক্রেতা বিক্রেতার সামনে কাপড় দেখার জন্য মেলে ধরবে, কিন্তু দরদামও শেষ করতে পারবে না, কাপড় গুটাতেও পারবে না; এক ব্যক্তি দুধ দোহন করে ঘরে নিয়ে বসবে, কিন্তু তা পান করতে পারবে না; এক ব্যক্তি হাউজ মেরামত করবে, কিন্তু তা থেকে পানি পান করতে পারবে না; এক ব্যক্তি লোকমা তুলবে, কিন্তু তা মুখে দিতে পারবে না এমন অবস্থায় কেয়ামত কায়েম হবে।’ (বুখারি: ৬৫০৬)
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। সেটা হবে অনেক কঠিন দিন।’ (সুরা মুদ্দাসসির: ৮-৯)
‘সেদিন জমিন ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং পাহাড়গুলো চলমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ১৪)। সেদিন ভূপৃষ্ঠ ভয়ঙ্করভাবে দুলতে থাকবে। ভূমিকম্পের ভয়াবহতায় মাটির নিচ থেকে সব স্বর্ণমুদ্রা বের হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘জমিন তার গর্ভে থাকা যাবতীয় স্বর্ণ-রৌপ্য বমি করে বের করে দেবে। তখন হত্যাকারী বলবে হায় এর জন্যই আমি অন্যকে হত্যা করেছি! ডাকাত বলবে হায় এর জন্যই আমি ডাকাতি করেছি! চোর বলবে হায় এর জন্যই আমি চুরি করেছি! এসব সম্পদ তাদের ডাকবে, কিন্তু কেউ কিছুই নিতে পারবে না।’ (মুসলিম: ১০১৩)। আকাশের অবস্থা অনেক ভয়াবহ হবে।
আকাশ ফেটে বিদীর্ণ হয়ে যাবে এবং টকটকে রক্তিম বর্ণ ধারণ করবে। আকাশের বিচূর্ণ খন্ডগুলো তুলোর মতো উড়তে থাকবে। (সুরা তুর: ৯; সুরা রহমান: ৩৭)। নক্ষত্র-তারকার অবস্থায় অনেক ভয়াবহ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্যকে নিষ্প্রভ করা হবে। নক্ষত্রগুলো খসে খসে পড়বে। পাহাড়গুলো উড়তে থাকবে। গর্ভবতী উটনীকে উপেক্ষা করা হবে। বন্য পশু একত্র করা হবে। সমুদ্র উত্তাল হবে।’ (সুরা তাকভির: ১-৬)। আল্লামা বাগাবি (রহ.) বলেন, ‘ঘর-বাড়ি-প্রাসাদ সব ধসে ধসে পড়তে থাকবে। দুগ্ধবতী নারীদের দুধ বের হয়ে যাবে। গর্ভবতীদের গর্ভপাত হয়ে যাবে। শিশুরা শুভ্রকেশ বৃদ্ধ হয়ে যাবে। শয়তান ভয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পালাতে থাকবে। মানুষজন ছোটাছুটি করতে থাকবে। কিন্তু বড় বড় গর্তের ভেতর পড়ে যাবে। এ দেখে পেছনের লোকেরা ভয়ে অন্য দিকে দৌড়াতে শুরু করবে।’ (আল-বুহুরুজ জাখিরাহ: ৫৮৩)। এভাবে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
হাশরের জন্য সর্বপ্রথম যার কবর খুলে দেওয়া হবে তিনি হলেন মহানবী (স.)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়ার পর সর্বপ্রথম আমি মাথা তুলব। তখন আমি দেখব, হজরত মুসা (আ.) আরশের এক পায়া ধরে আছেন। আমি জানব না, তিনি এভাবেই ছিলেন নাকি দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর সেখানে গিয়েছেন।’ (বুখারি: ৪৮১৩)
সেদিন জমিন পরিবর্তিত হয়ে অন্য জমিন হবে, সেদিন ময়দার রুটির মতো সাদা পরিষ্কার ও মসৃণ জমিনের বুকে মানবজাতিকে পুনরুত্থিত করা হবে। এতে কারও কোনো চিহ্ন (ঘর, উদ্যান, গাছ, পাহাড়, টিলা ইত্যাদি) থাকবে না। সেদিন সৃষ্টিকর্তার সামনে সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে, চেহারাগুলো অবনত থাকবে এবং সব সৃষ্টিই মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করবে; তখন চলাচলকারীদের পায়ের মৃদু আওয়াজ ও হালকা শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশও (পরিবর্তিত হবে) আর মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সামনে—যিনি এক, পরাক্রমশালী।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪৮)
আকাশ ও পৃথিবী পাল্টে দেওয়ার এমন অর্থও হতে পারে যে এগুলোর আকার ও আকৃতি পাল্টে দেওয়া হবে। সে সময় গোটা ভূ-পৃষ্ঠ একটি সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেওয়া হবে। এতে কোনো গৃহের ও বৃক্ষের আড়াল থাকবে না। পাহাড়, টিলা, গর্ত ও গভীরতা কিছুই থাকবে না। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতঃপর পৃথিবীকে মসৃণ সমতল ভূমি করে ছাড়বেন। তুমি তাতে মোড় ও টিলা দেখবে না।’ (সুরা ত্বহা: ১০৬ ও ১০৭)
পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব আদম সন্তানকে সেদিন কেয়ামতের ময়দানে একত্রিত করা হবে; সবাই তাদের রবের অভিমুখী থাকবে, তখন আর তাদের কোনোকিছুই গোপন থাকবে না। সেই দিনটি হবে খুবই ভয়ংকর, দুশ্চিন্তা ও কষ্টের; তারা নিজ নিজ কবর থেকে খাতনাবিহীন, খালি পা ও বস্ত্রহীন অবস্থায় দাঁড়াবে। অপরাধী, পাপাচারীদেরকে ঘিরে ধরবে কঠিন লাঞ্ছনা ও সংকটময় অবস্থা; আল্লাহর নির্দেশে তাদের তা এমনভাবে ছেয়ে ফেলবে যে সব শক্তি ও অনুভূতি এর সামনে অক্ষম হয়ে পড়বে। সেদিন নবী-রাসুল, সিদ্দিক (সত্যনিষ্ঠ) ও সৎকর্মশীলদের বস্ত্র পরিধান করানো হবে। সর্বপ্রথম যাকে বস্ত্র পরিধান করানো হবে তিনি হচ্ছেন হজরত ইবরাহিম খলিল (আ.)। (বুখারি : ৩১১২)
হজরত ইবরাহিমকে (আ.) সর্বপ্রথম কাপড় পরিধানের সম্মান দেওয়ার কারণ হচ্ছে— ইরাকের বাবেল শহরের অত্যাচারী বাদশাহ নমরুদ তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল। আগুনে নিক্ষেপের সময় তাঁর পরিধেয় বস্ত্র খুলে নেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর দীনের জন্য তিনিই প্রথম বস্ত্রহরণের অপমান সহ্য করেছিলেন। তাই তার জন্য বস্ত্রপরিধানের এ সম্মান। (মিরকাতুল মাফাতিহ: ১০/২৫২)
মানুষের শরীরের কোনো কাপড় না থাকলে একে অন্যের দিকে দৃষ্টি পড়তে পারে এবং লজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; আয়েশা (রা.) নবীজিকে এ কথা বললে নবীজি (স.) বললেন— ‘সেদিনের ভয়াবহতা এত গুরুতর হবে যে, কেউ কারও দিকে তাকানোর কল্পনাও করতে পারবে না। সবাইকে আপন আপন অবস্থা ব্যস্ত করে রাখবে।’ (বুখারি: ৬৫২৭; মুসলিম: ২১৯৪)
সেদিনটি হবে খুবই ভারী ও দুঃসহ; যা অবলোকন করবে আসমান ও জমিনের ভালো মন্দ সবাই। এমনকি সব ফেরেশতা ও নবী-রাসুলরাও উপস্থিত হবেন। মানুষ, জিন, পাখি ও প্রাণীকুল ইত্যাদি সৃষ্টির সবাইকেই সেদিন উপস্থিত করা হবে। সেদিন কিছু সংখ্যক মানুষ দয়াময় আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে; তারা সূর্যের তাপ, গরম ও সৃষ্টির নিশ্বাস থেকে নিরাপদ থাকবে। তারা হলেন—এক. ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), দুই. এমন যুবক যার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়, তিন. যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) চার. ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালবাসার ওপর মিলিত হয় এবং এই ভালবাসার ওপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়। পাঁচ. সেই ব্যক্তি যাকে কোনো সুন্দরী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ ছয়. সেই ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে, তা তার বাম হাতও জানতে পারে না। সাত. যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’ (বুখারি: ১৪২৩; মুসলিম: ১০৩১; তিরমিজি: ২৩৯১; নাসায়ি: ৫৩৮০)
সেদিন অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হবে, ব্যাপক ভিড় হবে, প্রচণ্ড গরম, তৃষ্ণা পাবে। তারপর মহান আল্লাহ কেয়ামতের ময়দানে তার নবীর জন্য হাউজে কাউসার উন্মুক্ত করে দেবেন। তারপর আরও কঠিন পরীক্ষা শুরু হবে; মানুষ দীর্ঘক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু ‘আল্লাহ তাআলা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করবেন না। মানুষ অসহনীয় দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতায় জর্জরিত হবে। লোকেরা বলতে থাকবে, তোমরা কী বিপদের সম্মুখীন হয়েছো তা কি দেখতে পাচ্ছ না? তোমরা কী এমন কাউকে খুঁজে বের করবে না, যে তোমাদের জন্য তোমাদের রবের কাছে সুপারিশকারী হবে? এমতাবস্থায় মানুষ সুপারিশের জন্য নবী কারিম (স.)-এর কাছে যাবেন। তিনি আল্লাহর হুকুমে সুপারিশ করবেন, তার শাফায়াত গ্রহণ করা হবে। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি কেয়ামতের দিন সকলের সরদার হবো। সেই কঠিন দিনের কষ্ট সইতে না পেরে মানুষ অস্থির হয়ে যাবে এবং যার দ্বারা সুপারিশ করালে আল্লাহ কবুল করবেন- এমন কাউকে খোঁজ করতে থাকবে। তারা অন্যান্য নবীর কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে সবাই আমার কাছে এসে বলবে, আপনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আমাদের কষ্ট তো আপনি দেখছেন, এখন দরবারে ইলাহিতে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন, যাতে আমাদের পরিত্রাণ দেওয়া হয়।’ (মেশকাত: ৫৫৭২)
কেয়ামতের দিন মহানবী (স.)-এর সুপারিশ ছাড়া জান্নাতের দরজাও খোলা হবে না। প্রিয়নবী (স.)-এর শাফাআতের পরই জান্নাতের দরজা খোলা হবে এবং যারা জান্নাতের উপযুক্ত, তারা সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামত দিবসে আমি জান্নাতের তোরণে এসে দরজা খোলার অনুমতি চাইব। তখন দ্বাররক্ষী বলবেন, আপনি কে? আমি উত্তর করব, মুহাম্মদ। দ্বাররক্ষী বলবেন, ‘আপনার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আপনার আগে অন্য কারো জন্য দরজা খুলিনি।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৭৪)
আল্লাহ তাআলা যেভাবে চাইবেন, সেভাবে চূড়ান্ত বিচার করবেন। ফেরেশতারাও পরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবে। আল্লাহ তাআলা যখন চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য সৃষ্টির সবার সামনে জ্যোতি প্রকাশ করবেন, তখন জমিন তার রবের নুরে উদ্ভাসিত ও আলোকিত হয়ে উঠবে। অতঃপর আমলনামা পেশ করা হবে যাতে ছোট ও বড়, সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই লিপিবদ্ধ থাকবে! ছোট বা বড় কোনো অপরাধ বাদ যাবে না, এমনকি যত তুচ্ছ আমল হোক না কেন তার হিসাব সেখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। সব গোপনীয়তা সেদিন প্রকাশ পেয়ে যাবে। মহান আল্লাহ তাদের সেই অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—
‘আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে- হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সুরা কাহাফ: ৪৯)
নেককার বান্দারা আমলনামা গ্রহণ করবেন ডান হাতে, আর বদকারদেরকে পেছন দিক থেকে বাম হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন নেককাররা আনন্দে আত্মহারা হবেন এবং অন্যদের ডেকে ডেকে নিজের আমলনামা দেখাবেন। বিষয়টি কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে—‘যাকে আমলনামা দেওয়া হবে তার ডান হাতে, সে বলবে, হে লোকজন! এই যে আমার আমলনামা তোমরা পড়ে দেখো; আমি আগেই বিশ্বাস করেছিলাম যে, আমাকে অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে!’ (সুরা হাক্কাহ: ১৯-২০)
বিচারের ভয়ে প্রত্যেক জাতিকে নতজানু হতে দেখা যাবে। কেয়ামতের দিন আল্লাহ বান্দার নিকটবর্তী হবেন এবং তার যাবতীয় অপরাধের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করবেন। সেদিন ন্যায়বিচারের পাল্লাগুলো (মিজান) স্থাপন করা হবে এবং ভালো-মন্দ যেকোনো আমল তা শস্যদানা পরিমাণ ওজনের হলেও পরিমাপ করা হবে। এতে কারও পাল্লা ভারী হবে আবার কারো হালকা হবে। আল্লাহ তার বান্দাদের সব কৃতকর্মের বিচার করবেন। ‘আর যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে, সে বলবে, হায়! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হতো! আমি যদি জানতেই না পারতাম আমার হিসাব কী? হায়! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত। আমার অর্থ-সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না। আমার থেকে আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেছে!’ (সুরা হাক্কাহ: ২৫-২৯)
যারা যার ইবাদত করত কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সেসবের অনুসরণ করতে বলবেন; তখন যার ইবাদত করত তার পিছু নেবে। জাহান্নামের ওপর সেতু স্থাপন করা হবে। এই পুলসিরাত কেবলমাত্র মুমিনরা অতিক্রম করবে। মুমিনরা যখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতের দরজাসমূহের কাছাকাছি পৌঁছাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝামাঝি এক পুলের কাছে তাদের আটকে রাখা হবে। তারপর দুনিয়ায় একের প্রতি অন্যের যা জুলুম ছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুলুমের ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে’ (সুরা শুআরা: ২২৭)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা আনআম: ৫৭)
অবশেষে যখন তারা একেবারে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ হয়ে যাবে তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। জাহান্নামিদের আফসোসের সীমা থাকবে না। পবিত্র কোরআনের সূরা আনআমের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘সে সময়ের অবস্থা যদি তুমি দেখতে- যখন অপরাধীদের জাহান্নামের সামনে দাঁড় করানো হবে; তখন তারা আফসোস আর মনের কষ্টে বলতে থাকবে- হায়! আমরা যদি দুনিয়ায় আবার ফিরে যেতে পারতাম এবং আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা মনে না করতাম এবং ঈমানদারদের দলে শামিল হতে পারতাম, তাহলে আজকের এ ভয়াবহ আজাবের মুখোমুখি হতে হতো না।’ এমন আফসোসের জবাবে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের আর দুনিয়ায় পাঠানো হবে না (সূরা আনআম: ২৮)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশুদ্ধ ঈমানের ওপর অবিচল রাখুন। আল্লাহকে ভয় করার তাওফিক দান করুন। কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।