মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মরক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশের যে বর্ণনা দিয়েছেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

মরক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশের যে বর্ণনা দিয়েছেন

বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা। জীবনের ৩০টি বছর ভ্রমণে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। ইবনে বতুতাই একমাত্র পরিব্রাজক যিনি সেসময়ের মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ এবং তৎকালীন সুলতানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তার ভ্রমণকাহিনির বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'আর রিহলা'। তিনি তার গ্রন্থে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সিলেট, সোনারগাঁ ভ্রমণের সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। 

'আর রিহলা' গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ ভারত থেকে ৪৩ দিন সাগর ভ্রমণ শেষে বাঙ্গালা (বাংলা) দেশের ‘সদকাওয়ান’ (চট্টগ্রাম) নামক জায়গায় পৌঁছান তিনি। চট্টগ্রাম বন্দরে তিনি অনেক সমুদ্রগামী জাহাজ দেখতে পান। তখন বাংলা অঞ্চলের স্বাধীন শাসক ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ (শাসনকাল ১৩৩৮-১৩৪৯)। এর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। 


বিজ্ঞাপন


ইবনে বতুতা ৯ই জুলাই, ১৩৪৬ সালে বাংলায় এসে পৌঁছান। সাদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) থেকে কামারু পর্বতের দিকে রওনা হন। সেখান থেকে কামারুর পথ ছিল এক মাসের। কামারু নামক যে স্থানটি তিনি পরিদর্শন করেন সেটি সম্ভবত ছিল খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও ত্রিপুরার পাহাড় বেষ্টিত আসামের অন্তর্গত শ্রীহট্ট (সিলেট)। 

তৎকালীন বাংলা অঞ্চল সম্পর্কে ইবনে বতুতার মন্তব্য—‘এ দেশে প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম। পক্ষান্তরে এ একটি অন্ধকার দেশ। খোরাসানের লোকেরা বলে, বাংলা ভালো জিনিসে পরিপূর্ণ একটি নরক (A Hell Full Of Good Things)।’

ভালো জিনিসে পরিপূর্ণ এক নরক এর অর্থ হলো- সুজলা সুফলা ও নয়নাভিরাম এই দেশের সব দামী জিনিসই সহজলভ্য। কিন্তু বিদেশিদের জন্য এখানে টিকে থাকাটা অসুবিধাজনক। তার মতে, ‘বাংলার আবহাওয়া আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মানুষের জন্য ছিল প্রচণ্ড প্রতিকূল। তার কারণ বৃষ্টির পানি ও শীতের কুয়াশা এখানে অসহনীয়। তার উপর এই অঞ্চলে রয়েছে নদীর প্রাধান্য। এজন্য সেই সময় বাংলায় আসাকে অনেকেই ভয় করত অথচ বাংলার ভূমি ছিল উর্বর।’


বিজ্ঞাপন


ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায়, বাংলাদেশে তখন মাত্র ১ দিরহামে ৮ টি মোটাতাজা মুরগি এবং ২ দিরহামে ১টি মোটাতাজা ভেড়া পাওয়া যেত। ইবনে বতুতা যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলার শাসক ছিল ফখরউদ্দীন। শাসনকর্তা হিসেবে তিনি উৎকৃষ্ট ছিলেন। ফখরউদ্দীন দরবেশ ও সুফিদের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করতেন।

ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার মূল উদ্দ্যেশ ছিল সিলেটের শেখ জালালুদ্দিন (শাহজালাল ইয়েমেনি রহ.) নামক এক প্রসিদ্ধ ধর্মপ্রাণ সাধু ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়ার পথে জালালুদ্দিনের বাসস্থান থেকে দুইদিনের পথ দূরে থাকতেই ইবনে বতুতা শেখের দুইজন শিষ্যের দেখা পান। শেখ জালালুদ্দিন তার শিষ্যদের ইবনে বতুতাকে অভর্থনা জানানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে বতুতা কোনো কিছুই জালালুদ্দিনকে আগে থেকে জানাননি। তবুও শেখ জালালুদ্দিন তার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। এ থেকেই ইবনে বতুতা শেখ জালালুদ্দিনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান।

ইবনে বতুতা শেখ জালালুদ্দিনের কাছে তিনদিনের আতিথ্যে ছিলেন। ইবনে বতুতার শেখ জালালুদ্দিনের একটি ছাগলের লোমের তৈরি আলখেল্লা পছন্দ হয়। ইবনে বতুতা তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শেখের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি ছাগলের লোমের তৈরি আলখাল্লা পরিধান করে আছেন। আলখাল্লাটি দেখে আমার পছন্দ হলে মনে মনে বললাম, আহা, শেখ যদি এটি আমাকে দান করতেন। পরে তার কাছে যখন বিদায় নিতে গেলাম, তিনি উঠে গুহার এক কোণে গিয়ে আলখাল্লাটি খুলে এসে আমার গায়ে পরিয়ে দিলেন এবং নিজের মাথার গোলটুপিটিও আমার মাথায় দিলেন। নিজে এলেন তালি লাগানো একটি পোষাকে।’

ইবনে বতুতা শেখের শিষ্যদের কাছ থেকে জানতে পেরে ছিলেন এই আলখাল্লা শুধু তিনি আসলেই শেখ পরিধান করতেন। শেখ জালালুদ্দিন তার আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমেই জেনে গিয়েছিলেন মরক্কোর এক পর্যটক এই আলখাল্লা চেয়ে নিবেন এবং সেই পর্যটকের থেকে এক বিধর্মী সুলতান সেই আলখাল্লাটি নিবেন। পরিশেষে সেই বিধর্মী সুলতান শেখের ভাই বোরাউদ্দিনকে সেই আলখাল্লাটি দিবেন। শেখ জালালুদ্দিন এই আলখাল্লাটি মূলত তার ভাই সাঘার্জের বোরাউদ্দিনের জন্য তৈরি করেছিল। ইবনে বতুতা ‘আর রিহলা’ গ্রন্থে এইসব বিবরণের কিছু কিছু বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন।

শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) সম্পর্কে ইবনে বতুতার মন্তব্য—‘এ শায়খের শ্রমের ফলে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়। এজন্য তিনি তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেন। সেখানের এক পর্বত কন্দরে তিনি ‘খানকাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই খানকাহ ছিল সাধু, দরবেশ, পরিব্রাজক ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত। তার জন্য খাদ্যদ্রব্যসহ নানা সামগ্রী উপহার আনত। এসব উপহারসামগ্রী দিয়ে তার আস্তানায় বহু লোককে খাওয়ানো হতো।

শেখ জালালুদ্দিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইবনে বতুতা আন-নহর উল-আজরাক (মেঘনা নদী) মধ্যে পনেরো দিনের পথ পাড়ি দিয়ে সোনারকাওয়ানে (সোনারগাঁও) পৌঁছান। এই পনের দিনের নদী পথের যাত্রায় বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। তার এই যাত্রাপথে নদীর দুই ধারে ফলের বাগান ও গ্রামাগুলো দেখতে পেয়েছিলেন, যা তিনি বাজারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘অসংখ্য নৌকা এই নদীপথে যাত্রা করতো, কিন্তু যখন একটি নৌকা অপর নৌকার সঙ্গে দেখা হতো তখন উভয়ে নিজেদের ঢাক পিটিয়ে অভিবাদন জানাত। সুলতান ফখরউদ্দীন সুফি দরবেশদের চলাচলের জন্য এই নদীতে কোনো ধরণের কর নিতেন না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলজ উপাদান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আন-নহর উল-আজরাক অর্থাৎ মেঘনা নদীকে তিনি মিশরের নীল নদের সাথে তুলনা করেছিলেন।’

ইবনে বতুতা প্রায় ৪৪টি দেশ ভ্রমণ করেন, দৈর্ঘ্যে যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার বা ৭৫ হাজার মাইল। বিশেষ করে তিনি সেই সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ বিবরণে স্পষ্ট— মধ্যযুগের বাংলা কত সমৃদ্ধ ছিল। তা থেকে বাংলার অতীত গৌরব সম্পর্কেও আঁচ করা যায়। তদুপরি, বাংলার এই ঐশ্বর্যশালী অবস্থানের কারণেই যে পরবর্তীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখানে হানা দিয়েছিল তা অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না।

(সূত্র: এইচ এ আর গীব ইবনে বতুতা, অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, ড. এনামুল হক, বঙ্গে সুফি প্রভাব, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য অবলম্বনে)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর