একজন আলেমের সারাদিন যত কাজই থাকুক না কেন, চাকরি বা ব্যবসা যে কাজে-ই নিয়োজিত থাকেন না কেন, তাঁর অধিকাংশ সময় কিংবা পুরোটা সময় ব্যয় হয় আল্লাহ তাআলার ইবাদতকারী হিসেবে। আল্লাহর দেওয়া ইলমের সঠিক ব্যবহারে এটি সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় তথা নিয়ত ও ইবাদত সম্পর্কে খুঁটিনাটি জ্ঞান তাদের কাছে স্পষ্ট থাকার কারণে তারা বেশি উপকৃত হন। এ কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে আলেম ও গাইরে আলেম সমান নন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হতে পারে?’ (সুরা রাদ: ১৬)
বিশুদ্ধ নিয়তে নেকি লাভ
অনেকে ভালো কাজ করেও নিয়তে গণ্ডগোলের কারণে নেকি অর্জন করতে পারেন না। এক্ষেত্রে একজন আলেম অল্প আমলেই অথবা কোনো আমল ছাড়াও সওয়াব পান। যেমন রাস্তার ডান পাশ দিয়ে আমরা বেখেয়ালেও চলাফেরা করি। এতে সওয়াব পাই না শুধুমাত্র নিয়ত ঠিক না করার কারণে। আলেম কখনও এই ভুল করেন না। তিনি আগে নিয়তকে শুদ্ধ করেন। অর্থাৎ তিনি সুন্নতের নিয়তে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করেন। আর প্রতি কদমে কদমে সওয়াব লুফে নেন। এটি একটি উদাহরণ। এরকম হাজারো উদাহরণ আছে, যা জানার জন্য দীনি ইলম অর্জন করতে হবে, আলেমদের শরণাপন্ন হতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আলেমের মর্যাদা ও বিদ্বেষপোষণের পরিণতি
যদি নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকে তাহলে যেকোনো কাজ যতই সুন্দর হোক না কেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহর কাছে সেই কাজ গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। নিয়ত সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘বলে দাও যেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ী কাজ করে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৮৪)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজের আশা করল, অতঃপর তা করতে পারল না, তবুও তার জন্য সওয়াব লেখা হবে।’ (সহিহ বুখারি)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শয়নকালে রাত্রিবেলায় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার নিয়ত করে শুয়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত ঘুমের চাপে ভোর হয়ে গেছে, সে তার নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব পাবে। তার ঘুমই আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব হিসেবে গণ্য হবে।’ (নাসায়ি: ৩/২৫৮)
বিজ্ঞাপন
আমাদের অনেকে সাধারণত দুনিয়া লাভের আশায় নিয়ত করে থাকি কিন্তু পরকালে শান্তি লাভের আশায় নিয়ত রাখি না। এটি সওয়াব অর্জনের পথে আরেক অন্তরায়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যে কেউ পরকালীন ফসল চায়, তার ফসল বৃদ্ধি করি। আর যে লোক দুনিয়ার ফসল চায় তাকে দুনিয়া হতে দান করি। কিন্তু পরকালের তার কিছুই প্রাপ্য হবে না। (সুরা আশ শুরা: ২০)
আরও পড়ুন: পরকালে ১০ শ্রেণির মানুষের ভয়-চিন্তা নেই
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার নিয়ত রাখবে, আমি তাকে ইহজগতে যতটুকু ইচ্ছা প্রদান করব। অতঃপর তার জন্য দোজখ নির্ধারণ করব। সে এতে দুর্দশাগ্রস্ত বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আখেরাতের নিয়ত রাখবে এবং তার জন্য যেমন চেষ্টার প্রয়োজন তেমন চেষ্টাও করবে। যদি সে প্রকৃত মুমিন হয় এরূপ লোকদের চেষ্টা কবুল হবে। (সুরা বনি ইসরাইল: ১৮-১৯)
চুপ থাকায় নেকি
জিহ্বার অপব্যবহারের কারণে জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ ও দুর্ভোগ। অনিয়ন্ত্রিত লাগামহীন কথাবার্তা ঝগড়াঝাঁটিরও মূল কারণ। তাই যত কম কথা বলা যায় ততই কল্যাণকর। ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, যে নীরবতা অবলম্বন করে সে মুক্তি পায়। (তিরমিজি: ২৪৮৫)
নীরবতার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে বেহুদা কথার গুনাহ থেকে মুক্তি, গিবত-অপবাদ থেকে মুক্তি ছাড়াও অনুসরণ করা হয় রাসুলুল্লাহর (স.) সুন্নাহ। মহানবী (স.) অনেক বেশি চুপ থাকতেন। মনে রাখতে হবে, মুখ দিয়ে বের হওয়া কথাটা সওয়াবের হবে, নতুবা গুনাহের। সুতরাং হয়, ভালো কথা বলা, না হলে চুপ থাকাই উত্তম। ইরশাদ হচ্ছে—‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার কাজে সচেতন পাহারাদার (ফেরেশতা) তার নিকটে রয়েছে।’ (সুরা কাহাফ: ১৮)
আরও পড়ুন: ১১ শ্রেণির মানুষের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন
সাহল ইবনে সাদ (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (অঙ্গ জিভ) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (গুপ্তাঙ্গের হেফাজত) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো।’ (বুখারি: ৬৪৭৪; (তিরমিজি: ২৪০৯)
অনুমোদনহীন ইবাদত থেকে বিরত থাকায় নেকি লাভ
নবী কারিম (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কাজ করল অথচ ওই কাজে আমার কোনো অনুমোদন নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারি: ২৪৯৯)। এই হাদিসে লক্ষ্য করুন, সুন্নতের পরিপন্থী কোনো আমলে সওয়াব তো নেই-ই, উল্টো মারাত্মক গুনাহ। আমাদের অনেকে অজ্ঞতার কারণে এমন এমন ভালো কাজ করতে আগ্রহী হই, যে কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে সুন্নাহ কী বলছে, ভেবে দেখি না। ফলে বিদআতে জড়িয়ে পড়ি এবং সওয়াব থেকে বঞ্চিত হই। বিদআত প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ হচ্ছে এতে বোঝানো হয় যে, শরিয়ত অপূর্ণ। অথচ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা দীন পরিপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম...।’ (সুরা মায়েদা: ৮৯)
আরও পড়ুন: বিদআতে জড়িতরা কেয়ামতের দিন লাঞ্ছিত হবেন
তাই ইবাদত করার জন্য নবীজির তরিকা বেছে নিতে হবে। ধরেন, আপনার চারপাশে হয়ত অনেকে সুন্নত পরিপন্থী ইবাদতে বা বিদআতে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ তাদেরকে শুধরে দিলেও তারা তা মানছে না। বরং বিদআতকে সুন্নত হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে। এই অবস্থায় আপনি সুন্নত অনুসরণের নিয়তে বিদআতকে বর্জন করুন। প্রয়োজনে সকল ফিতনা থেকে বাঁচতে চুপ হয়ে থাকুন। এতেই আপনার সওয়াব হবে। অর্থাৎ কিছু না করেই সওয়াব। এক হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘ফিতনার সময় ঈমানদারের করণীয় হলো- সর্বদা চুপ থাকা। এত পরিমাণ চুপ থাকা, যার কারণে কোনো ফিতনা তাকে আকৃষ্ট করতে না পারে। (আল ফিতান: ৭৩৫)
বিপদাপদে ধৈর্যের কারণে নেকি
আল্লাহ তাআলা এতই মেহেরবান যে তিনি কোনো কারণে আমাদের ওপর আপতিত বিপদাপদের বিনিময়েও সওয়াব দিয়ে থাকেন। রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যেসব বিপদাপদ আসে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তার পাপ মাফ করে দেন। এমনকি শরীরে কাঁটা ফুটলেও এর কারণে পাপমোচন হয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৪০)
অন্য বর্ণনায় আছে, ‘তার জন্য একটি নেকি লেখা হবে এবং তার মর্যাদা এক ধাপ বৃদ্ধি করা হবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম: ১২৮৪)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, মহানবী (স.) বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ (বুখারি: ৫৬৪১)
আরও পড়ুন: মুমিনের বিপদ-আপদ আল্লাহর ভালোবাসার প্রমাণ!
বিপদ-মসিবতে সবরকারীদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব (কখনো) ভয়-ভীতি, (কখনো) ক্ষুধা দিয়ে এবং (কখনো) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে, আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)
ইবাদতে পূর্ণ আনুগত্যে নেকি
ইবাদত করেও অনেকে সওয়াব অর্জন করতে পারেন না। আসলে অনুগত না হয়ে ইবাদতের কোনো মূল্য নেই। তাই ইবাদত করতে হবে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয় নিয়ে পূর্ণ অনুগত হয়ে। অনেকেই তাড়াহুড়ো করে হুটহাট করে নামাজ পড়েন, যেন নামাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তার অপেক্ষায় আছে। এতে সওয়াবের আশা করা যায় না। ইবাদত শব্দের অর্থই হলো অনুগত হওয়া, নত হওয়া, আনুগত্য করা। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘ইবাদত হচ্ছে বিনয়ের সঙ্গে আনুগত্য’ (মিরআত: ১/৬১)। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘ইবাদতের শাব্দিক অর্থ হলো নীচতা-হীনতা, আর পারিভাষিক অর্থ- পরিপূর্ণ ভালোবাসা, বিনয় ও ভীতির সমষ্টি।’ (ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, ১/১৩৪)
তাই ইবাদত করার সময় অনুগত হওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এতে কোনো পরিশ্রম নেই। ইবাদত তো ঠিকই করে যাচ্ছেন, সঙ্গে আনুগত্য যোগ করতে হবে। এতেই বিপুল পরিমাণ সওয়াব অর্জন হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আল্লাহ তাআলা শুধু ওই আমল কবুল করবেন, যে আমল কেবল আল্লাহর জন্য করা হবে এবং আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে।’ (নাসায়ি: ৩১৪০)
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুক্তি নেই
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ আমাদেরকে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তাই আমাদের কাজ হবে সুন্নাহ অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করা। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তুমি বলো, আমার সালাত, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব জাহানের রব আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি, আর আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমি হলাম প্রথম।’ (সুরা আনআম: ১৬২-১৬৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাওহিদ, ঈমান, কুফর সম্পর্কিত জ্ঞানের পাশাপাশি শুদ্ধ নিয়ত ও ইবাদতের যাবতীয় জ্ঞান আহরণের তাওফিক দান করুন। শিরক-বিদআত থেকে মুক্ত রাখুন। দিনের অধিকাংশ সময় ইবাদতে কাটানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।