শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

আলেমের মর্যাদা ও বিদ্বেষপোষণের পরিণতি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ মে ২০২২, ০৬:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

আলেমের মর্যাদা ও বিদ্বেষপোষণের পরিণতি

নবীজি (স.) এই দুনিয়ায় পুনরায় আগমন করবেন না। তবে তিনি রেখে গেছেন একদল সোনালি মানুষ। যাঁদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়ারাদু আনহু’ (অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট, আল্লাহ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট)। তাঁদের বলা হয় ‘সাহাবা’। তাঁরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রথম উত্তরাধিকারী। সাহাবায়ে কেরামের পর এই আসমানি সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছেন তাবেয়িগণ। এরপর তাবে-তাবেয়িগণ।

এভাবেই চলমান রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আসমানি আমানত রক্ষার পবিত্র ধারা। আল্লাহ যত দিন চাইবেন এ ধারা বহমান থাকবে। যুগে যুগে যাঁরা এই আসমানি আমানত রক্ষা করে আসছেন, তাঁরাই যুগের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে তাফসির, হাদিসসম্ভার, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামি জ্ঞানের সুবিন্যস্ত ভাণ্ডার।


বিজ্ঞাপন


তাঁদের কাছেই মানুষ লাভ করে কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান। চিনতে পারে নিজের প্রভুকে। মানুষ খুঁজে পায় নিজের আসল পরিচয়। শিখতে পারে আল্লাহর বিধি-বিধান। চিনতে পারে হালাল-হারামকে। তাঁদের সংস্পর্শে এসেই অন্ধকার জগতের মানুষ সন্ধান পায় আলোকিত জীবনের। মৃত হৃদয়গুলো হয় পুনরুজ্জীবিত। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে উন্মত্ত মানুষ আখেরাতমুখী জীবন ধারণ করে। তাঁরা পৃথিবীর জন্য রহমত। তাঁরা উম্মতের জন্য বরকত। পরমহিতৈষী ও মঙ্গলকামী।

তাঁদের কাছে ইসলাম সবার আগে। তাঁরা দীনের অতন্দ্র প্রহরী। দীন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট।

আল্লাহ তাআলা তাঁদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’(সুরা আলে ইমরান: ১৮)

আল-কোরআনে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের সঙ্গেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের আনুগত্যেরও। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাঁদের।’ (সুরা নিসা: ৫৯)


বিজ্ঞাপন


যেকোনো শরয়ি সমস্যা নিরসনে তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে।’ (সুরা নাহল: ৪৩)

তাই একজন আলেম দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি কোন আলেম চলে গেলে পুরো দেশ ও সমাজ অচল হয়ে পড়ে। যেহেতু আলেম-ওলামায়ে কেরাম না থাকলে দীন ও দীনের জ্ঞান চর্চা হবে না, পৃথিবীর সব মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। সেজন্যে একজন প্রকৃত আলেমকে দান করা হয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা।

আলেমরা সম্মানিত

উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২১৪৩)

আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ

রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী, আর নবীরা উত্তরাধিকার হিসেবে দিনার ও দিরহাম (অর্থকড়ি) রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন ইলম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে বিপুল অংশ লাভ করেছে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪৩)

আলেমের নেক আমল মৃত্যুর পরও জারি থাকে

একজন আলেম জীবিত অবস্থায় ইলম বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হন। আর সে কারণে মৃত্যুবরণ করার পরও তিনি সওয়াব পেতে থাকেন। বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৩১০)

সকল সৃষ্টি আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে

আলেমের জন্য বড়ই সুসংবাদ যে, তার জন্য আল্লাহর নিকট সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও।’(মুসনাদ আবু ইআলা: ২/২৬০)

আল্লাহ তাআলা আলেমদের শান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে— আল্লাহ তাআলা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং ফেরেশতাগণ, আলেমগণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। (সুরা আলে ইমরান: ৩)

আলেমদের বিরুদ্ধাচরণের কুফল

আলেমদের  প্রতি অবজ্ঞা বা ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলে, তাদের নিয়ে উপহাস বা ঠাট্টা করলে বা বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর।

‘যদি কেউ কোনো আলেম বা ফকিহকে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) গালি দেয়, তাহলে সে কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ (আল-বাহরুর রায়েক: ৫/১৩২)

‘যদি কেউ ইসলামী শরিয়ত বা তা শরিয়তের সুস্পষ্ট কোনো মাসয়ালা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তাহলে সে কুফরি কাজ করল। যদি কেউ কোনো আলেমের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে, তাহলে তার কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কেউ কোনো ফকিহ আলেমকে বা হজরত আলী (রা.)-এর বংশধরকে গালি দেয়, তাহলে (একদল ফুকাহায়ে কেরামের মতে) সে কাফির হয়ে যাবে, তার স্ত্রী তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে।’ (মাজমাউল আনহুর: ১/৬৯৫, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ২/২৭০, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া: ৫/৫০৮)

ইমাম ত্বহাবি (রহ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল আকিদাতুত তহাবিয়্যায় লিখেছেন— পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম যারা হাদিস, ফিকহ ও দীনি দূরদর্শীতাসম্পন্ন, ন্যায়সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাদের সমালোচনা করা জায়েজ নেই। যারা অন্যায়ভাবে তাদের সমালোচনা করবে তারা গোমরাহ হিসেবে গণ্য হবে। (আল আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-১৪৫)

ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামকে অবজ্ঞা করবে তার আখিরাত ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি রাজা-বাদশাহদের অবজ্ঞা করবে তার দুনিয়া ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি নিজের ভাইকে অবজ্ঞা করবে তার মানবিকতা ধ্বংস হবে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৮/৪০৮)

ইমাম আহমদ ইবনে আজরায়ি (রহ.) বলেন, উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনা করা, বিশেষ করে পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের, এটা কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব রাখবে, এর দ্বারা তার নিজেরই ক্ষতি হবে। (আররদ্দুল ওয়াফের: ১৯৭)

আলেমদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার নামান্তর। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব।’ (বুখারি: ৬৫০২)

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন— ‘তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে। নিজে সৎকর্ম করে এবং এ-ও বলে যে, নিশ্চয়ই আমি একজন মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা হা মীম সাজদা: ৩৩)

অতএব, ইসলামি বিধি-বিধানের প্রকৃত মূল্যবোধ বজায় ও জাগরিত রাখার জন্য আলেম-ওলামাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আস্থাশীল হতে হবে। তাদের প্রতি মান্যতা থাকতে হবে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। বিরুদ্ধাচারণ করা যাবে না। কারণ, আলেমদের বিরোধিতা করা ইসলামবিরোধী হওয়ার নামান্তর।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আলেমদের ব্যাপারে নম্র, ভদ্র ও শোভনীয় আচরণ করার, তাদের সঙ্গে বিদ্বেষপোষণ না করার, তাঁদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করার এবং তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর