ঈমান মুমিনের শক্তি। শত বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-কষ্টে একজন মুমিন ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন ঈমানের বলে। জীবনের ভালো-মন্দ সব বিষয়কে তিনি এভাবে চিন্তা করেন যে এতে নিশ্চয় মহান স্রষ্টার প্রজ্ঞা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ফলে অশান্ত হৃদয় প্রশান্ত হয়, অস্থির মন খুঁজে পায় স্বস্তি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘..যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনে তার কোনো ক্ষতি ও কোনো অন্যায়ের আশঙ্কা থাকবে না।’ (সুরা জ্বিন: ১৩)
যে ব্যক্তি ঈমানের সম্পদ থেকে বঞ্চিত সে বহু ক্ষেত্রে মানসিক প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত। বৈরী পরিস্থিতি তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি বাহ্যিক সব উপায়-উপকরণ থাকার পরও তার অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও ভয় দূর হয় না। দিশাহারা হয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে বসে, মা-বাবা সন্তানকে এবং সন্তান মা-বাবাকে পর্যন্ত হত্যা করে। অনেক উচ্চশিক্ষিত, ধনাঢ্য ও সম্পদশালী ব্যক্তিও তাতে লিপ্ত হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোরআনি সচেতনতা
কিন্তু যিনি ঈমানের নূরে আলোকিত তিনি হতাশাগ্রস্থ হন না, ভেঙে পড়েন না। আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করেন। ঈমানই তাকে প্রতিকূলতায় ধৈর্যশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। নানা বিপদ-আপদ, সংকটে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা—‘আমি তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয় আর এরাই সৎপথে পরিচালিত।’ (সুরা বাকারা: ১৫৬-১৫৭)
ঈমানদার যেহেতু আল্লাহর ওপর ভরসাকারী, আল্লাহর ইচ্ছার ওপর অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল, সঠিক পথে টিকে থাকা তার পক্ষে খুবই সহজ। মহান আল্লাহই তাঁকে সাহায্য করেন এবং সুপথে পরিচালিত করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদই আপতিত হয় না এবং যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।’ (সুরা তাগাবুন: ১১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তার অন্তরে বিশ্বাসের পথনির্দেশ দেন। ফলে বুঝতে পারে বিপদের কারণে সে ভুল করেনি এবং তার ভুলের কারণে বিপদ হয়নি। বরং তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ছিল। এভাবে মুমিন অনুতাপ, অনুশোচনা ও মানসিক কষ্ট থেকে বেঁচে যায়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: বিপদ-মসিবতে দোয়া ইউনুস পড়ার উপকারিতা
আল্লাহর জিকির, আন্তরিক তওবা মুমিনের মানসিক প্রশান্তির আরেকটি কারণ। এসব মনের শক্তিকে তরান্বিত করে। আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা ঈমান আনে আল্লাহর স্মরণে তাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়, নিশ্চয় আল্লাহর স্মরণে হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ: ২৮)। তওবাকারীদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হও, আল্লাহ তাআলা তার বান্দার তাওবাতে এরচেয়েও বেশি খুশি হন।’ (বুখারি: ৬৭০৯)
এসব বিষয়গুলো মনে প্রশান্তি ও সাহস জোগায়। যা একমাত্র মুমিন ব্যক্তিই লাভ করে থাকেন। আর গুনাহ করতে করতে যাদের অন্তর কঠিন হয়ে যায় তাদের মনের শক্তি দুর্বল হতে থাকে এবং সদা ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। পরকালীন শাস্তির একটি চাপ তো মাথায় থাকেই। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার হুঁশিয়ারি—‘দুর্ভোগ ওই লোকদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণ থেকে কঠোর। তারা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।’ (সুরা জুমার: ২২)
আরও পড়ুন: মুসলিম হয়েও জান্নাতে যাবেন না যারা
যার ঈমান যত শক্ত, মানসিকভাবে সে ততই শক্ত। প্রকৃত ঈমানদার স্বভাবতই অযথা কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকার কারণে নানা কল্যাণ লাভ করে থাকে। এছাড়াও ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত, অহংকার থেকে মুক্ত থাকেন প্রকৃত মুমিন। ফলে জাগতিক নানা ঝামেলা থেকে তাঁকে আল্লাহ মুক্তি দেন। এরপরও কখনও আল্লাহর শত্রুদের হামলা বা কারো অত্যাচারের শিকার হলে আল্লাহ তাকে প্রত্যেকটি খারাপ মুহূর্তের জন্য বিশেষ সওয়াব দিয়ে থাকেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুমিনের বিষয়টি কতইনা চমৎকার! তার জন্য কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নেই। তার জন্য যদি কোনো খুশির ব্যাপার হয় এবং সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে তাহলে সেটি তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোনো দুঃখের বিষয় হয় এবং সে ধৈর্য ধারণ করে, সেটিও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)
ফলে মুমিনের সাহস বেড়ে যায়। ভালো কাজের ইচ্ছা প্রবল হয় এবং দুনিয়াবি কোনো ভয় অন্তরে কাজ করে না। ইসলামের শিক্ষাই হলো মুমিনরা সাহসী হবে। এখানে সাহস বলতে সৎসাহস উদ্দেশ্য। ‘ভালো কাজের প্রবল ইচ্ছা এবং পার্থিব পরিণতি উপেক্ষা করাই সৎসাহস।’ (তারিফাত, পৃষ্ঠা-৩২০)
আরও পড়ুন: সাহসীরা আল্লাহর প্রিয়
অর্থাৎ মুমিন আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। সবসময় সত্যের পথে দৃঢ় থাকবে। যা করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করবে। নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। পূর্ববর্তীরা এসব গুণেই গুণান্বিত ছিলেন। উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যেখানেই থাকি না কেন, সত্যের ওপর দৃঢ় থাকব কিংবা বলেছিলেন, সত্য কথা বলব এবং আল্লাহর কাজে কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করব না।’ (বুখারি: ৭২০০)
কৃপণতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য নয়। এসব মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ভীরু, কাপুরুষ ও কৃপণ মানসিকতা দ্বারা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেওয়াও সম্ভব নয়। এ কারণে মহানবী (স.) সর্বদা এই ত্রুটিগুলো থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন ‘হে আল্লাহ! আমি কৃপণতা থেকে আপনার আশ্রয় চাইছি। আমি কাপুরুষতা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আমি অবহেলিত বার্ধক্যে উপনীত হওয়া থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আর আমি দুনিয়ার ফেতনা অর্থাৎ দাজ্জালের ফেতনা থেকেও আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমি কবরের আজাব থেকেও আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (বুখারি: ৬৩৬৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ঈমানের নূরে আলোকিত করুন। সৎসাহসী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।