১৮ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস’। ২০১২ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এই দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য গভীর। ১৯৭৩ সালের এই দিনেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আরবি ভাষা দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে (প্রস্তাবনা ৩১৯০ [XXVIII])। এটি কেবল প্রশাসনিক স্বীকৃতি নয়; বরং আরবি ভাষার প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডার, সভ্যতাগত অবদান এবং বিশ্বজনীন প্রভাবের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ৪২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা আরবি। ইসলামি সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষা আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় জ্ঞান, আইন ও সংস্কৃতির বাহক হয়ে ওঠে। তাই আরবি কেবল একটি আঞ্চলিক ভাষা নয়; এটি একাধারে পবিত্র ভাষা, জ্ঞানচর্চার মাধ্যম এবং আধুনিক বিশ্বের কার্যকর যোগাযোগভাষা।
বিজ্ঞাপন
ইসলামের হৃদয়ে আরবি ভাষা
কোরআনুল কারিমের ভাষা হিসেবে আরবির গুরুত্ব অনন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি একে আরবি কোরআনরূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সুরা ইউসুফ: ২)
নামাজ, তেলাওয়াত, দোয়া, হজের তালবিয়া- ইসলামের প্রতিটি মৌলিক ইবাদতেই আরবি ভাষার সরাসরি ব্যবহার ইসলামের সার্বজনীন ঐক্যকে সুসংহত করেছে। কোরআনের ভাষাগত সৌন্দর্য ও গভীরতা আরবি ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব ও অলংকারশাস্ত্রকে ইসলামি জ্ঞানচর্চার একটি স্বতন্ত্র শাখায় পরিণত করেছে।
বিজ্ঞাপন
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেতুবন্ধন
মধ্যযুগে বাগদাদ, দামেস্ক ও কর্ডোবার মতো জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে আরবি ছিল বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রধান ভাষা। আল-খাওয়ারিজমির বীজগণিত, ইবনে সিনার চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং আল-ফারাবি ও ইবনে রুশদের দর্শনগ্রন্থ-সবই আরবি ভাষায় রচিত।
গ্রিক, ফারসি ও ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডার আরবি অনুবাদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরবি শব্দ আল-কিমিয়া থেকেই ইংরেজি Alchemy শব্দটির উৎপত্তি, আর জাবির ইবনে হাইয়ানের গবেষণা আধুনিক Chemistry বিজ্ঞানের বিকাশে মৌলিক অবদান রেখেছে।
আধুনিক বিশ্বে আরবির ভূমিকা
আজ আরবি জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষার একটি। জ্বালানি অর্থনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে আরবি ভাষাভাষী অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে কূটনীতিক, গবেষক ও আন্তর্জাতিক পেশাজীবীদের জন্য আরবি ভাষাজ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতায় পরিণত হয়েছে।
ডিজিটাল যুগেও আরবি পিছিয়ে নেই। ইন্টারনেটে বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় আরবি শীর্ষ দশে রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ভাষা প্রযুক্তি, কোরআনিক অ্যাপ, অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরবি কনটেন্ট দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ক্লাসিক্যাল আরবি, আধুনিক মানক আরবি এবং আঞ্চলিক উপভাষার সহাবস্থান ভাষাটিকে একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ও গতিশীল করে তুলেছে।
আরও পড়ুন: ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকায়ন: কোরআন-সুন্নাহর আলোকে একটি সমন্বিত রূপকল্প
বাংলাদেশ ও অনারব বিশ্বে আরবির গুরুত্ব
বাংলাদেশে আরবি ভাষার গুরুত্ব বহুমাত্রিক। ধর্মীয় শিক্ষায় আরবি অপরিহার্য হলেও এর ব্যবহার কেবল ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থান, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরবি ভাষাজ্ঞান বড় ধরনের পেশাগত সুবিধা এনে দিচ্ছে।
শ্রমবাজার, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতেও আরবি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আরবিকে প্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষা হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব ভবিষ্যতে আরবি শিক্ষার প্রসারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
আরবি ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ রয়েছে- যেমন ভুল উচ্চারণ, ধর্মীয় আরবি ও ব্যবহারিক আরবির মধ্যে ব্যবধান এবং অনারব সমাজে সীমিত প্রয়োগ। এসব মোকাবিলায় মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে আরবি শিক্ষার সমন্বয় এবং মানসম্মত ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ প্রয়োজন।
আরবি ভাষা অতীতের গৌরবময় স্মৃতির বাহক হওয়ার পাশাপাশি আজও ধর্ম, শিক্ষা, কূটনীতি ও প্রযুক্তির সংযোগস্থলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- এই ভাষার সঠিক চর্চা শুধু ধর্মীয় পরিচয়কে দৃঢ় করে না, বরং আধুনিক বিশ্বে কার্যকর যোগাযোগ ও বৈশ্বিক নাগরিকত্বের পথও সুগম করে।
ভাষা হিসেবে আরবির এই বহুমাত্রিকতা আগামী প্রজন্মকে ঐতিহ্যের গরিমা ও আধুনিকতার দক্ষতা- উভয় দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করবে এবং একটি যোগাযোগে সক্ষম ও সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে।

