ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসা, প্রায়শই ঐতিহ্যবাহী পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান, উন্নত ভাষা ও কারিগরি শিক্ষার অভাব এখানে প্রকট। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকীকরণের একটি সুসংগঠিত রূপরেখা নিচে তুলে ধরা হলো।
১. শিক্ষাক্রমে সমন্বয়: দ্বীন ও দুনিয়ার ভারসাম্য
ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক ও দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয় অপরিহার্য। এতে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন দ্বীনি জ্ঞানে পারদর্শী হবে, তেমনি সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবে।
বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়: পাঠ্যক্রমে ফিকহ ও তাফসিরের পাশাপাশি পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও পরিবেশবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কি লক্ষ করে না উটের দিকে, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? আর আসমানের দিকে, কীভাবে তা উঁচু করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়াহ: ১৭-১৮) এই আয়াতগুলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চাকে ইবাদত হিসেবে উৎসাহিত করে। তুরস্কের প্রস্তাবিত ইস্তানবুল ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক বিজ্ঞান ও ইসলামিক সায়েন্সকে একীভূত করার চেষ্টা করছে।
ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য আরবি, ইংরেজি ও বাংলার সমন্বিত শিক্ষা অপরিহার্য। হাদিসের আলোকে, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ) এই জ্ঞান অর্জনের জন্য ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য TOEFL/IELTS প্রস্তুতির পাশাপাশি কার্যকরী ইংরেজি ও আরবি কোর্স চালু করা উচিত। বিশ্বব্যাপী দাওয়াতের জন্য চাইনিজ বা জাপানিজ ভাষার মতো আন্তর্জাতিক ভাষার বেসিক কোর্সও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
বিজ্ঞাপন
২. প্রযুক্তির ব্যবহার: ডিজিটাল ইসলামিক শিক্ষা
একবিংশ শতাব্দীর এই প্রযুক্তি নির্ভর যুগে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক করতে ডিজিটাল শিক্ষার সরঞ্জাম ও পদ্ধতি ব্যবহার করা জরুরি।
স্মার্ট ক্লাসরুম ও ভার্চুয়াল লার্নিং: শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগ এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদানকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বিভিন্ন রিসোর্স অ্যাক্সেস করতে পারবে এবং বৈশ্বিক ইসলামিক স্কলারদের লেকচার শুনতে পারবে। মালয়েশিয়ার International Islamic University Malaysia (IIUM)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো AI, রোবোটিক্স ও ইসলামিক ইথিক্স একসাথে পড়াচ্ছে, যা প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের উদাহরণ। বাংলাদেশেও আল-হেরা একাডেমি অনলাইনে ফিকহ ও প্রোগ্রামিং কোর্স চালু করেছে।
ইসলামিক অ্যাপস ও ই-লাইব্রেরি: মাদ্রাসায় ‘মাদ্রাসা ডিজিটাল ল্যাব’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে তাফসির ইবনে কাসির, সহিহ বুখারির মতো সফটওয়্যার এবং আধুনিক কোডিং টুলস একসাথে শেখানো হবে। Coursera বা edX-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে ইসলামিক স্টাডিজের অনলাইন কোর্স চালু করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
৩. বাস্তব জীবনের প্রয়োগ: বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
ইসলামিক ফাইন্যান্স ও সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ: শিক্ষার্থীদের ইসলামিক ব্যাংকিং, হালাল ফুড টেকনোলজি ও সোশ্যাল বিজনেস মডেলের উপর ডিপ্লোমা কোর্স করানো যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫) এটি হালাল উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করে।
কারিগরি শিক্ষা: মাদ্রাসায় সোলার প্যানেল ইনস্টলেশন, মোবাইল রিপেয়ারিং ও গ্রাফিক ডিজাইনের মতো কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। হাদিসের আলোকে, ‘নিজ হাতে উপার্জন করা আল্লাহর প্রিয় বান্দার কাজ।’ (বুখারি) আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যৌথ প্রোগ্রাম চালু করে, যেমন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-এর সাথে ইসলামিক স্টাডিজ ও ডাটা সায়েন্সের সমন্বিত কোর্স, শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের সুযোগ বাড়াতে পারে।
আরও পড়ুন: শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বয়স সম্পর্কে যা বলছে ইসলাম
৪. গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র না রেখে গবেষণা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য।
সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা: মাদ্রাসায় ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইসলামিক নৈতিকতা’ বা ‘জলবায়ু পরিবর্তন: খলীফার দায়িত্ব’ (সুরা বাকারা: ৩০-এর আলোকে) এর মতো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গভীর গবেষণার সুযোগ তৈরি করা উচিত। আল-কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে গবেষণা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সূরা মুহাম্মাদ: ২৪) এই আয়াত গবেষণা ও গভীর পর্যবেক্ষণের প্রতি উৎসাহিত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় লিংকেজ: আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণা ও শিক্ষা বিনিময়ের জন্য লিংকেজ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং MIT-এর যৌথ গবেষণা প্রোগ্রাম এর একটি উল্লেখযোগ্য মডেল। বাংলাদেশে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)-কে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
৫. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকীকরণে সরকার ও সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নীতিমালা সংস্কার: সরকার কর্তৃক আধুনিক ও সমন্বিত ধর্মীয় শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। এতে আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) বিষয়গুলো যোগ করা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড-এ আধুনিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা জরুরি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন ব্ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায় তখন মানুষের ধ্বংস অনিবার্য।’ (তিরমিজি) একটি সুষম নীতিমালা সুষ্ঠু ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।
ফান্ডিং মডেল: ওয়াকফভিত্তিক ফান্ড (যেমন সৌদি আরবের King Abdullah Scholarship Program-এর আদলে) এবং CSR (Corporate Social Responsibility) ফান্ড থেকে টেক-ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
টেকসই ইসলামিক শিক্ষার রূপরেখা
ধর্মীয় শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করতে হলে ‘৩টি C’-এর উপর জোর দিতে হবে:
১. Content (কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক আধুনিক পাঠ্যক্রম)
২. Context (বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী)
৩. Creativity (প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োগ)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করেন।’ (সুরা ফাতির: ২৮) এই আয়াতের আলোকে, জ্ঞানের সকল শাখাকে ইসলামি মূল্যবোধের সাথে একীভূত করাই হোক আমাদের লক্ষ্য। তিউনিশিয়ার Zaytuna College-এর মতো সফল মডেল, যেখানে শরিয়াহ ও আধুনিক বিজ্ঞান একসাথে পড়ানো হয়, তা অনুসরণযোগ্য। বাংলাদেশের বেফাকুল মাদারিস-এর সাথে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (BUP)-এর মতো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা এই রূপরেখা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এই সমন্বিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোকে বিশ্বব্যাপী ইসলামিক শিক্ষার নতুন মডেল করে তুলতে পারে।

