মানুষের অন্তরে অন্যের দুঃখ দেখে ব্যথিত হওয়া আল্লাহ তাআলার দান করা এক বিশেষ গুণ। এটি মানবতার পরিচয় হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এটি ঈমানেরও জীবন্ত প্রকাশ। কোরআন-হাদিসে অসহায় মানুষের প্রতি দয়া, সহানুভূতি ও সহযোগিতাকে প্রকৃত ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা হয়েছে। মুমিনের অনুভূতি তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা বাস্তব কর্মে রূপ নেয়।
মুমিনের হৃদয়ের বৈশিষ্ট্য: করুণা ও সহানুভূতি
কোরআন মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে দরিদ্র ও অভাবীদের সহায়তাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর: ৮)
আরেক আয়াতে তিনি বলেন, ‘অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের।’ (সুরা বালাদ: ১৭)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া ও আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল: ৯০)
এই ঘোষণাগুলো প্রমাণ করে- অসহায়ের কষ্ট অনুভব করা মুমিনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কঠোর ও অনুভূতিহীন হৃদয় ইসলামের চরিত্র নয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: দরিদ্রদের সাহায্যে জান্নাতের ওয়াদা, কোরআন-হাদিসের ৭ নির্দেশনা
নবীজির দয়া: মানবতার আদর্শ ও মুমিনের পথনির্দেশ
আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মদ (স.)-কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন- ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের প্রতি রহমত হিসেবে।’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)
তিনি ছিলেন গরিব, এতিম, বিধবা ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল। তাঁর চরিত্রই ইসলামে দয়ার মূল মানদণ্ড। এক হাদিসে এসেছে, নবীজিকে বলা হলো- হে আল্লাহর রাসুল, আপনি মুশরিকদের জন্য অভিসম্পাত করুন। তখন তিনি বলেন, ‘আমাকে অভিসম্পাতকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি। আমাকে রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৯৯)
নবীজি (স.) বলেন, ‘যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তাআলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তাআলাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি: ১৯২৪)
হৃদয় নরম করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি তুমি তোমার অন্তরকে নরম করতে চাও, তবে মিসকিনকে খাবার খাওয়াও এবং এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।’ (সহিহুল জামে, আনিসু-সারি ফি তাখরিজি আহাদিসি ফাতহিল বারি, পৃষ্ঠা ৬২৩) অতএব, অসহায়ের কষ্ট দেখে যার হৃদয় ব্যথিত হয়, সে আল্লাহর বিশেষ রহমতের যোগ্য। অসহায়ের প্রতি মায়া অনুভব করা জীবন্ত হৃদয়ের লক্ষণ।
উম্মাহর পারস্পরিক দায়িত্ব ও আল্লাহর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
মুসলিম সমাজকে এক দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন রাসুলুল্লাহ (স.)। তিনি বলেন, ‘সকল মুসলিম একজন ব্যক্তির সমতুল্য। যদি তার চক্ষু পীড়িত হয় তবে তার সমগ্র দেহ পীড়িত হয়ে পড়ে। যদি তার মাথা আক্রান্ত হয় তাহলে সমগ্র শরীরই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৮৬)
অন্যের কষ্টে সহানুভূতি ও সহযোগিতার বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকেও অঙ্গীকার রয়েছে। নবীজি (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে,আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দুর করবে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (সহিহ বুখারি: ২৪৪২) ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাই এর সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)
অতএব, অসহায় মানুষের দুঃখে দুঃখ পাওয়া কেবল অনুভূতি নয়; এটি আল্লাহর সাহায্য লাভের দরজা।
আরও পড়ুন: রোগী দেখাসহ ৪ আমলের প্রতিদান জান্নাত
অসহায়ের অধিকার লঙ্ঘনের কঠোর সতর্কতা
কোরআন ও হাদিসে অসহায়ের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনকারীদের জন্য ভয়াবহ সতর্কতা উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘এতিমের ওপর কঠোর হবেন না; ভিক্ষুককে ধমক দিবেন না।’ (সুরা দুহা: ৯–১০)
আরও বলা হয়েছে, ‘সে-ই আখেরাতকে অস্বীকার করে, যে এতিমকে তাড়িয়ে দেয় এবং মিসকিনকে আহারদানে উৎসাহিত করে না।’ (সুরা মাউন: ১–৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) সতর্ক করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।’ (সহিহ বুখারি: ৬০১৩; সহিহ মুসলিম: ২৩১৯) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘কেবল হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর ও দুর্ভাগা মানুষের কাছ থেকেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।’ (তিরমিজি: ১৯২৩)
তাই অসহায়ের অধিকার উপেক্ষা করা সামাজিক ব্যর্থতা হওয়ার পাশাপাশি আখেরাতের দুর্ভাগ্যেরও কারণ।
ইসলামের নির্দেশনা: অনুভূতি থেকে বাস্তব দায়িত্বে রূপান্তর
ইসলামে অসহায় মানুষের অধিকার শুধু নৈতিকতার বিষয় নয়; বরং একটি আর্থসামাজিক দায়িত্ব। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত: ১৯)
এই দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন দান-সদকা, জাকাত প্রদান, এতিম ও মিসকিনদের প্রতিপালন, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবেশীর হক রক্ষা ইত্যাদি। যে ব্যক্তি অসহায়ের দুঃখে হৃদয়বিদারিত হয়, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। আর যে তাদের পাশে দাঁড়ায়, আল্লাহ তাঁর পাশে দাঁড়ান।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হৃদয়কে নরম করুন, মানবসেবায় নিয়োজিত করুন এবং অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দিন। আমিন।

