ইসলামে জীবন রক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোগ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করা নবীজির সুন্নত। নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ পাঠাননি যার আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননি।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৭৮) তবে চিকিৎসক যদি অমুসলিম হন, তাহলে তার কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়া যাবে কি না- এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। শরিয়তের দলিল, হাদিস এবং চার মাজাহাবের ফিকহি ব্যাখ্যার আলোকে এই প্রতিবেদনে বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হলো।
মূলনীতি: শর্তসাপেক্ষ বৈধতা
ইসলামে চিকিৎসকের ধর্ম নয়, বরং তার চিকিৎসা পদ্ধতির শরয়ি অবস্থানই মূল বিবেচ্য। চিকিৎসা যদি বৈধ উপাদানে পরিচালিত হয় এবং তাতে শিরক বা কুফরের কোনো উপাদান না থাকে, তাহলে অমুসলিম চিকিৎসক বা কবিরাজের কাছ থেকেও চিকিৎসা গ্রহণ করা জায়েজ।
বৈধতার শর্ত: শিরক-কুফরি পদ্ধতি পরিহার
অমুসলিম কবিরাজের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ তখনই বৈধ যখন তার ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি তাওহিদবিরোধী না হয়। শিরকি তাবিজ, কুফরি লেখাযুক্ত তন্ত্র, রহস্যময় মন্ত্র, জাদু-টোনা, জ্বিন-ভূত ডেকে তাওহিদ পরিপন্থী চিকিৎসা পদ্ধতি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব পদ্ধতির প্রতি বিশ্বাস রাখা বা ব্যবহার করা ঈমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নবীজি (স.) সতর্ক করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গণকের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মদের ওপর যা নাজিল হয়েছে তার বাইরে চলে গেল।’ (আবু দাউদ: ৩৯০৪) অর্থাৎ শিরকি ও কুফরি উপাদানসমৃদ্ধ চিকিৎসা ইসলামে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিজ্ঞাপন
বৈধ চিকিৎসা পদ্ধতি ও ফিকহি দলিল
যে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক বা ভেষজ নির্ভর যেমন আয়ুর্বেদিক, হার্বাল, আকুপ্রেশার, আকুপাংচার, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি- যাতে কোনো শিরক বা কুসংস্কার যুক্ত না থাকলে সেগুলো ব্যবহার জায়েজ। ফিকহি গ্রন্থসমূহে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, অমুসলিম চিকিৎসকের চিকিৎসা গ্রহণ বৈধ- যদি সে বিশ্বস্ত হয় এবং তার চিকিৎসায় কোনো হারাম উপাদান না থাকে।
ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, ‘মুসলিমের জন্য অমুসলিম চিকিৎসকের চিকিৎসা গ্রহণ বৈধ; যদি সে বিশ্বস্ত হয় এবং তার চিকিৎসায় কোনো হারাম না থাকে।’ (আল-মুগনি) চার মাজহাবের ফকিহগণ- হানাফি, মালিকি, শাফেঈ ও হাম্বলি প্রায় একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। ইতিহাসেও পাওয়া যায়, সাহাবায়ে কেরাম অমুসলিম চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং নবীজি (স.) তাতে নিষেধ করেননি।
শরয়ি সীমার বাইরে হলে চিকিৎসা হারাম
যে চিকিৎসায় স্পষ্ট শিরক, কুফরি বা ইসলামের নিষিদ্ধ পদ্ধতি যুক্ত থাকে, তার প্রতি ভরসা করা বা এসব দ্বারা চিকিৎসা নেওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তিনি প্রত্যেক রোগের জন্য নিরাময়ও রেখেছেন তাই তোমরা চিকিৎসা করো, তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৭০)
আরও পড়ুন: অমুসলিম সালাম দিলে জবাব দেয়ার নিয়ম কী
একইভাবে, যদি কোনো কবিরাজ চিকিৎসার নামে ধর্মান্তরের আহ্বান করে, অমুসলিম ধর্মাচরণে অংশ নিতে বাধ্য করে বা রোগীর বিশ্বাসে আঘাত করে- এ ধরনের চিকিৎসা নেওয়া বৈধ নয়। সুস্থতা দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। নবী ইবরাহিম (আ.) বলেন, ‘এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন।’ (সুরা শুআরা: ৮০)
অতএব, ইসলামি শরিয়তে চিকিৎসকের ধর্ম নয়, তার ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতির বৈধতাই মূল বিবেচ্য। শিরক, কুফরি বা জাদুটোনা যুক্ত নয়—এমন বৈধ চিকিৎসা হলে অমুসলিম কবিরাজের কাছ থেকেও গ্রহণ করা জায়েজ। তবে মুসলিম চিকিৎসক পাওয়া গেলে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়াই উত্তম। শেষ পর্যন্ত আরোগ্য আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই; চিকিৎসা কেবল একটি মাধ্যম।

