সৃষ্টির রহস্যপটে আল্লাহ তাআলার কুদরতের তিনটি মহান নিদর্শন- আরশ, কুরসি ও লাওহে মাহফুজ। এ যেন ইলম ও কুদরতের ত্রিভুবন, যার প্রতিটিতে লুকিয়ে আছে আল্লাহর মহিমার অপার বিস্তার। কোরআনের আয়াত আর নবীজির হাদিসের ঝলমলে আলোয় সাজানো এই লেখায় আমরা খুঁজে বের করব সৃষ্টির সেই সূচনালগ্নের কথা, যখন আরশ-কুরসি সৃষ্টি ও লাওহের পৃষ্ঠায় লিখে দেওয়া হয়েছিল কেয়ামত পর্যন্তের ইতিহাস।
আরশ: আল্লাহর সর্ববৃহৎ সৃষ্টি ও সিংহাসন
কোরআনে বহু স্থানে আরশের উল্লেখ এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহিমান্বিত আল্লাহ, যিনি প্রকৃত মালিক, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের অধিপতি।’ (সুরা মুমিনুন: ১১৬)
তাফসিরকার ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, ‘আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা ও মালিক। কারণ, তিনি আরশের অধিপতি, যা সৃষ্টিজগতের ছাদের মতো। আসমান–জমিন ও তাদের মধ্যবর্তী সব কিছু আরশের নিচে অবস্থান করছে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, ২/৪০৫)
আরশ ধারণকারী ফেরেশতাদের সম্পর্কেও কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশে আছে, তারা তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং তাঁর ওপর ঈমান রাখে।’ (সুরা মুমিন: ৭)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে সকল ফিরিশতা আরশ বহন করেন, তাদের একজনের সম্পর্কে বর্ণনা করার জন্য আমাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল, আর তার কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হলো সাতশ বছরের দূরত্বের সমান।’ (আবু দাউদ: ৪৭২৭)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ফেরেশতারা যেভাবে আল্লাহর ভয়ে কাঁপে
কুরসি: আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রতীক
আরশের পরে সবচেয়ে মহিমান্বিত সৃষ্টির একটি হলো কুরসি। যা আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার মহিমান্বিত প্রতীক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাঁর কুরসি আসমান ও জমিনকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে।’ (সুরা বাকারা: ২৫৫)
তাফসিরকারদের মতে, কুরসি হলো আল্লাহর জ্ঞানের বিস্তৃতি ও ক্ষমতার প্রতীক। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কুরসি হলো আল্লাহর কুদরতের পা রাখার স্থান। আর আরশ হলো তাঁর মহান সিংহাসন।’ আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহর আরশের তুলনায় কুরসি এত ছোট যে তা বিশাল মরুভূমিতে পড়ে থাকা একটি আংটির মতো।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৪)
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এই হাদিসের সূত্র সহিহ, যা কুরসি ও আরশের মধ্যকার বিশাল পার্থক্য নির্দেশ করে।
লাওহে মাহফুজ: সংরক্ষিত ভাগ্যের ফলক
‘লাওহে মাহফুজ’ শব্দটি আরবি, অর্থ সংরক্ষিত ফলক। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি সেই বিশেষ স্থান, যেখানে আল্লাহ তাআলা সমগ্র সৃষ্টি, জীবনের সমস্ত ঘটনা ও কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় এটি একটি সম্মানিত কিতাব, যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত।’ (সুরা বুরুজ: ২১–২২) আরও বলেন, ‘আল্লাহ জানেন যা কিছু আকাশে ও ভূমণ্ডলে আছে; এসব বিষয় কিতাবে লিখিত আছে, এবং এটা আল্লাহর কাছে সহজ।’ (সুরা হজ: ৭০)
আরও পড়ুন: তাকদিরে লেখা আছে বলেই কি মানুষ গুনাহ করে?
তাফসিরে কুরতুবি ও অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে-
- ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘লাওহে মাহফুজ লাল ইয়াকুত পাথরে নির্মিত, এর উপরাংশ আরশের সঙ্গে সংযুক্ত।’
- ইমাম সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ লাওহে মাহফুজকে একশ বছরের দূরত্বের পথসমান সৃষ্টি করেছেন।’
- আবার ইবনে কাসির (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘এর দৈর্ঘ্য আসমান–জমিনের সমান এবং তা নির্মিত সাদা মণিমুক্তা দ্বারা।’
হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ প্রথমে কলম সৃষ্টি করেন এবং বলেন, ‘লিখো।’ কলম বলল, ‘কি লিখব?’ আল্লাহ বললেন, ‘কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব লিখে ফেলো।’ (সহিহ মুসলিম) এভাবেই কলম ও লাওহে মাহফুজের মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টির ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে।
বিশ্বাসগত তাৎপর্য
১. আকিদার অংশ: আরশ, কুরসি ও লাওহে মাহফুজে ঈমান আনা ইসলামি আকিদার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এগুলোর প্রকৃতি বা রূপ আল্লাহই সর্বজ্ঞাত।
২. তাকদিরে বিশ্বাস: লাওহে মাহফুজে সবকিছু লিখিত থাকা তাকদিরে বিশ্বাসের মূলভিত্তি। এতে মানুষ শেখে- ঘটনা যেভাবেই ঘটুক, তা আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার অংশ।
৩. আল্লাহর মহিমা অনুধাবন: আরশ ও কুরসির বিশালতা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও অসীম জ্ঞানের প্রমাণ। এগুলো মানুষকে তাঁর মহত্ত্বে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
সারকথা, আরশ, কুরসি ও লাওহে মাহফুজ—এই তিনটি সৃষ্টি ইসলামি বিশ্বাসের গভীর রহস্যময় ও গৌরবময় দিক। মুমিনের কর্তব্য এগুলোর প্রতি ঈমান রাখা, তবে এর প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতূহলী বিতর্কে না যাওয়া। যেমনটি রাসুল (স.) নির্দেশ দিয়েছেন। একজন মুমিনের জন্য এই উপলব্ধিই হলো প্রকৃত ঈমানের প্রশান্তি।

