শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

তাকদিরে লেখা আছে বলেই কি মানুষ গুনাহ করে?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ জুন ২০২৩, ০৬:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

তাকদিরে লেখা আছে বলেই কি মানুষ গুনাহ করে?

তাকদির আরবি শব্দ। অর্থ- নির্ধারণ করা, নিয়তি, ভাগ্যলিপি, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এই মহাবিশ্বে ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা তাঁর পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব নির্ধারণ করে রাখাকে তাকদির বলে। পৃথিবীর সব বস্তু তথা মানব-দানবসহ যত সৃষ্টি রয়েছে, সব কিছুর উত্থান-পতন, ভালো-মন্দ, উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি কোথায়, কোন সময়, কিভাবে ঘটবে—আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। 

তাকদির দুই প্রকার—১. তাকদিরে মুবরাম (অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপি) ও ২. তাকদিরে মুআল্লাক (ঝুলন্ত ভাগ্যলিপি)। তাকদিরে মুবরাম কখনোই পরিবর্তিত হয় না। আর তাকদিরে মুআল্লাক বান্দার নেক আমল, দোয়া ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, দোয়া আল্লাহর ফয়সালাকে পরিবর্তন করাতে পারে। আর নেক আমল বয়সকে বৃদ্ধি করাতে পারে।’ (তিরমিজি: ২১৩৯)


বিজ্ঞাপন


তাকদিরে মুবরাম বা মুআল্লাক সবকিছুই আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছেন। ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টির ভাগ্যলিপি লিখে রেখেছেন, আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, তখন আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর।’ (মুসলিম: ২৬৫৩)

মানুষের ভালো কাজ হোক বা খারাপ কাজ কোনোকিছুই তাকদিরের লিখন থেকে বাদ পড়েনি। এক কথায়, তাকদিরের বাইরে কোনো কিছু নেই। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসই তাকদির অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও।’ (মুসলিম, রিয়াদুস সালিহিন, পৃ-২৮২)

কিছু মানুষ প্রশ্ন করেন- সবকিছুই যদি তাকদির অনুযায়ী হয়ে থাকে, তাহলে গুনাহের দায়ভার কেন বান্দার হবে? এর উত্তর হলো—তাকদির অনুযায়ী সবকিছু হয়, তাকদিরের কারণে হয় না। অর্থাৎ ভবিষ্যতে মানুষ যা করবে, আল্লাহ তাআলা তা আগে থেকেই জানেন, ফলে তিনি তা আদিতেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আদিতে লিপিবদ্ধ করার কারণে মানুষ লেখা অনুযায়ী কর্ম করছে—এ কথা মোটেও ঠিক নয়। বরং আমরা কখন কী করব, কী খাব, কোথায় কী ঘটবে—এগুলো আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকে জানেন। কারণ তিনি ইলমে গায়েবের অধিকারী। 

উদাহরণস্বরূপ- আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে পারলেন যে- অমুক তারিখ ওই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হবে। বিষয়টি তিনি লিখেও রাখলেন। দেখা গেলো সত্যিই ওই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন এ কথা বলা কি উচিত হবে যে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ লিখে রাখার কারণে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে? 


বিজ্ঞাপন


ঠিক একইভাবে আল্লাহ তাআলা ইলমে গায়েবের অধিকারী হওয়ায় সব বিষয় জানেন এবং লিখে রেখেছেন। কিন্তু এই লিখে রাখার কারণে মানুষ সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হয় না বা গুনাহ করে না। বরং গুনাহের কারণ হলো তার ইচ্ছা। ফলে ব্যক্তির গুনাহের জন্য সে নিজেই দায়ী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পাবে এবং সে আল্লাহ ছাড়া নিজের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আর নারী-পুরুষের মধ্য থেকে যারাই সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অণু পরিমাণও তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা নিসা: ১২৩-১২৪)

অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অপকর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে।’ (সুরা জিলজাল: ৭-৮)

তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন—লেখো। কলম বলল, হে রব! কী লিখব? তিনি বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাকদির লেখো।’ (আবু দাউদ: ৪৭০০) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তুমি কি জানো না যে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে আল্লাহ সব কিছু জানেন। নিশ্চয়ই এসব কিতাবে লেখা আছে। অবশ্যই এটা আল্লাহর কাছে সহজ।’ (সুরা হজ: ৭০)

সব কিছুর সত্তা, বৈশিষ্ট্য, গতি, স্থিতি—সবই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।’ (সুরা জুমার: ৬২) 

তাকদিরের সঙ্গে তদবিরের কোনো সংঘাত নেই। কেননা তাকদিরের ওপর ঈমান আনার সঙ্গে কাজের ওপর তদবির করার কথাও লিখিত আছে। হাদিসে রয়েছে, জনৈক সাহাবি আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যে ঝাড়ফুঁক করে থাকি, চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার করে থাকি কিংবা আত্মরক্ষার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কি তাকদিরের কোনো কিছুকে পরিবর্তন করতে পারে? প্রত্যুত্তরে রাসুল (স.) বলেন, তোমাদের এসব চেষ্টাও তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। (বায়হাকি) 

অর্থাৎ প্রত্যেক কাজ তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। এখন আমরা তাকদির নিয়ে পড়ছি-সেটাও তাকদির তথা ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। তবে, তাকদির নিয়ে অযথা তর্কাতর্কি বর্জনীয়। হাদিস শরিফে তাকদির প্রসঙ্গে বিতর্ক করতে বারণ করা হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাকদিরের বিষয়ে কথা বলে, কেয়ামতের ময়দানে এ কারণে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর যে এ বিষয়ে আলোচনা করবে না, তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৮৪)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুল (স.) আমাদের কাছে এলেন, আমরা তখন তাকদির প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তখন রাসুল (স.) প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগে তাঁর চেহারা আনারের মতো রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, তোমরা কি এসব করতে আদিষ্ট হয়েছ? নাকি আমি এসবের জন্য প্রেরিত হয়েছি? এর আগের লোকজন এ বিষয়ে আলোচনা করে ধ্বংস হয়েছে, আমি তোমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। (তিরমিজি: ২১৩৩)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাকদিরের ওপর বিশ্বাস রাখার তাওফিক দান করুন। তাকদিরের ব্যাপারে অযথা বাক্যালাপ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর