নামাজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। মুসলমানের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। তবে প্রশ্ন হলো- এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান কি কেবল হাদিসে এসেছে, নাকি কোরআনেও এর স্পষ্ট প্রমাণ আছে? অনেকের মনে এ বিষয়ে সংশয় দেখা দেয়। অথচ কোরআন ও হাদিস উভয় ক্ষেত্রেই নামাজের ফরজিয়াত ও এর নির্দিষ্ট সময় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ফিকহের ইমামগণ একমত যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় আল্লাহ তাআলাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন- ‘নামাজের সময় হজের সময়ের মতো নির্ধারিত।’ (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম, পৃ. ১০৫৭)
বিজ্ঞাপন
নামাজের সময় নির্ধারিত হওয়ার ব্যাপারে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩) মুজাহিদ (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- ‘সুনির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করা ফরজ।’ (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম, পৃ. ১০৫৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কোরআনে বর্ণিত আছে। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তেলাওয়াত করলেন- ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সন্ধ্যায় ও প্রভাতে। আর অপরাহ্নে ও জোহরের সময়ে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সব প্রশংসা তাঁরই।’ (সুরা রোম: ১৭-১৮) তিনি ব্যাখ্যা করলেন- ‘সন্ধ্যায়’ দ্বারা মাগরিব ও এশা, ‘প্রভাতে’ দ্বারা ফজর, ‘অপরাহ্নে’ দ্বারা আছর এবং ‘জোহরের সময়ে’ দ্বারা জোহরের নামাজ বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে কুরতুবি, ১৬/৪০৮)
আরও পড়ুন: কোন ওয়াক্ত নামাজ কত রাকাত পড়া জরুরি
কাতাদা (রহ.)-সহ একদল মুফাসসির বলেন, উক্ত আয়াতে চার ওয়াক্ত নামাজের উল্লেখ আছে; এশার নামাজের উল্লেখ রয়েছে অন্য আয়াতে- ‘তুমি নামাজ কায়েম করো দিনের দুই প্রান্ত ভাগে ও রাতের প্রথমাংশে।’ (সুরা হুদ: ১১৪) এখানে ‘রাতের প্রথমাংশ’ দ্বারা এশার নামাজ বোঝানো হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কোরআনে আরও একাধিক আয়াতে নামাজের সময় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- ‘সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম করবে এবং কায়েম করবে ফজরের নামাজ। নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৭৮)
মুজাহিদ (রহ.) বলেন- সূর্য হেলে পড়া দ্বারা জোহর, রাতের ঘন অন্ধকার দ্বারা মাগরিব উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তুমি নামাজ কায়েম করো দিনের দুই প্রান্ত ভাগে ও রাতের প্রথমাংশে।’ (সুরা হুদ: ১১৪) হাসান বসরি (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন- দিনের দুই প্রান্ত দ্বারা ফজর, জোহর ও আছর আর রাতের প্রথমাংশ দ্বারা মাগরিব ও এশা উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ৬টি বড় পুরস্কার
একইভাবে কোরআনের অন্য আয়াতেও ইঙ্গিত আছে- ‘সুতরাং তারা যা বলে, সে বিষয়ে তুমি ধৈর্য ধারণ করো এবং সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। আর রাতে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং দিবসের প্রান্তগুলোতেও যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পারো।’ (সুরা তাহা: ১৩০; আহকামুল কোরআন লিল-জাসসাস, নামাজের সময় অধ্যায়)
উপরের আয়াতসমূহ ও মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুধু হাদিসের মাধ্যমে নয়, বরং কোরআন করিমের দ্বারাও সুপ্রমাণিত।
হাদিসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রমাণ
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হাদিসে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ।’ লোকটি জিজ্ঞেস করল, এর বাইরে আর কিছু কি ফরজ আছে? তিনি বললেন, ‘না; তবে ইচ্ছে করলে নফল আদায় করতে পারো।’ (সহিহ বুখারি: ৪৬, সহিহ মুসলিম: ১১)
আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর সূত্রে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মাদ! এই হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। প্রত্যেক সালাতের জন্য দশ গুণ, অর্থাৎ মোট পঞ্চাশ সালাতের সমান সওয়াব।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬২, জামে তিরমিজি: ২১৩)
আরও পড়ুন: যে দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়লে জান্নাতের গ্যারান্টি দিয়েছেন নবীজি
হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে নামাজের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে দুই দিন ধরে ব্যবহারিকভাবে নামাজের সময় শিক্ষা দেন। প্রথম দিনের সময়সূচি: জোহর সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর, আছর সূর্য এখনো উঁচু ও সাদা অবস্থায়, মাগরিব সূর্য অস্ত যাওয়ার পরপরই, এশা শাফাক (সন্ধ্যার লালিমা) মিলিয়ে গেলে এবং ফজর ভোরের আলো ফুটলে। দ্বিতীয় দিনের সময়সূচি: জোহর রোদ কিছুটা ঠান্ডা হওয়ার পর (বিলম্বিত), আছর সূর্য কিছুটা উঁচু অবস্থায় (প্রথম দিনের চেয়ে বিলম্বিত), মাগরিব শাফাক মিলিয়ে যাওয়ার আগেই (তাড়াতাড়ি), এশা রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত (বিলম্বিত) এবং ফজর পুরোপুরি ভোর হওয়ার পর। দুই দিনের নামাজ শেষে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- ‘তোমাদের নামাজের সময় এই দুই দিনে তোমরা যা দেখেছ, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।’ (সহিহ মুসলিম: ৬১৩)
এ হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ফরজিয়াত এবং এর গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয়ের সুযোগ নেই। ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব ও এশা—এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আল্লাহ তাআলাই সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং মহানবী (স.) আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং একজন মুমিনের জন্য এ নামাজসমূহ সময়মতো আদায় করা শুধু ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং ঈমানের অপরিহার্য অংশ।

