মোহরানা ইসলামে স্ত্রীর মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর ফলে স্ত্রীর অধিকার খর্ব হয় এবং অনেক সময় বৈবাহিক সম্পর্কে অশান্তি দেখা দেয়। নিচে মোহরানা সম্পর্কিত পাঁচটি প্রচলিত ভুল ধারণা এবং তার শরিয়তসম্মত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলো।
১. ‘মোহর শুধু আনুষ্ঠানিকতা, দিতে হবে না’
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন মোহর কেবলমাত্র বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ, বাস্তবে এটি পরিশোধ না করলেও চলে।
সঠিক ব্যাখ্যা: কোরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেন- ‘তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশিমনে।’ (সুরা নিসা: ৪)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিবাহ করল এ নিয়তে যে তার মোহর আদায় করবে না, সে জেনাকারী।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৪/৫২২-৫২৩)
অতএব, মোহর কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি স্ত্রীর একান্ত অধিকার।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: বিয়ের কত দিনের মধ্যে মোহরানা পরিশোধ করা উত্তম
২. ‘বিয়ের পর মোহর কমানো যায়’
ভুল ধারণা: অনেকের ধারণা, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর সম্মতিতে মোহর কমিয়ে নেওয়া যায়।
সঠিক ব্যাখ্যা: মোহর স্ত্রীর একচ্ছত্র অধিকার। স্বামী জোরপূর্বক কমাতে পারবে না। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কোনো অংশ ছেড়ে দেয়, তখন স্বামী তা গ্রহণ করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘স্ত্রীরা যদি খুশিমনে তাদের মোহর থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা ভোগ করো।’ (সুরা নিসা: ৪)
কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বাধ্য করে মোহর কমানো যাবে না। (রদ্দুল মুহতার: ৩/১০২)
৩. ‘অতিরিক্ত মোহর ধার্য করে পরে মাফ করিয়ে নেওয়া যায়’
ভুল ধারণা: অনেক সময় বেশি মোহর নির্ধারণ করে ধারণা করা হয়, পরে স্ত্রীকে দিয়ে তা মাফ করিয়ে নেওয়া সম্ভব।
সঠিক ব্যাখ্যা: এটি ধোঁকাবাজি, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘প্রতারণাকারী ও ধোঁকাবাজকারীদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ ( তিরমিজি: ১৩১৫ )
তাই মোহর নির্ধারণের সময় বাস্তবসম্মত হওয়া জরুরি। (ফাতহুল মুলহিম: ৩/৪৭৬)
আরও পড়ুন: মোহরানা পরিশোধের উত্তম সময় কখন
৪. ‘মোহরানা যেকোনো অল্প টাকায় ধার্য করা যায়’
ভুল ধারণা: কারও কারও ধারণা, মোহর যেকোনো অল্প পরিমাণ অর্থ বা নামমাত্র কিছু দিলেই হয়ে যায়।
সঠিক ব্যাখ্যা: মোহর এমন হওয়া উচিত, যা সামাজিকভাবে সম্মানজনক। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর স্ত্রীদের মোহর নির্ধারণ করেছেন প্রায় ৫০০ দিরহাম। (সহিহ মুসলিম: ১৪২৬; আবু দাউদ: ২১০৫)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ ১০ দিরহাম (প্রায় ৩০ গ্রাম রূপার সমমূল্য)। (ইমদাদুল আহকাম: ২/৩৬৫)
অতএব, মোহর এমন হতে হবে যা স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষায় যথাযথ।
৫. ‘মোহর পরিশোধ না করলেও কোনো শাস্তি নেই’
ভুল ধারণা: অনেকের বিশ্বাস, মোহর না দিলেও দুনিয়ায় বা আখেরাতে কোনো শাস্তি নেই।
সঠিক ব্যাখ্যা: মোহর পরিশোধ না করা একটি বড় গুনাহ। স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ মোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না। (আহকামুল কোরআন, জাসসাস: ২/৫৭-৫৮; ইবনে কাসির: ১/৪৪২; বয়ানুল কোরআন: ২/৯৩; তাফসিরে উসমানি: পৃ. ১০০) এমনকি মৃত্যুসময়ও মোহর পরিশোধ করা ফরজ। (তাফসিরে কুরতুবি: ৫/৬৭)
আরও পড়ুন: স্ত্রী মাফ করে দিলে কি মোহর মাফ হয়?
মোটকথা, ইসলামে মোহরানা বিবাহের অপরিহার্য অংশ। এটি স্ত্রীর সম্মান ও আর্থিক অধিকারের প্রতীক। এ বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করা বা স্ত্রীর হক খর্ব করা ইসলাম অনুমোদন করে না। তাই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হলো মোহর যথাযথভাবে আদায় করা এবং এ বিষয়ে শরিয়তের নির্দেশনা মেনে চলা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মোহরানার হক যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

