মানব ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা নিজেদের চরিত্র, পবিত্রতা ও নৈতিক উৎকর্ষের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)। জাহিলি যুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেও তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন পবিত্রতা, সততা ও নৈতিকতার এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর সমগ্র জীবনই মানবজাতির জন্য এক অনুপম শিক্ষা।
সদগুণের পরিপূর্ণ সমন্বয়
নবী কারিম (স.)-এর জীবন ছিল সদগুণের এক পরিপূর্ণ সমন্বয়। তিনি ছিলেন চিন্তার যথার্থতা, পারদর্শিতা এবং ন্যায়পরায়ণতার জ্বলন্ত প্রতীক। আল্লাহ তাআলা তাঁকে দিয়েছিলেন সুষম দেহসৌষ্ঠব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের নিশ্চয়তা। তরুণ বয়স থেকেই তিনি নীরবতা ও গভীর চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকতেন। তাঁর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও নির্ভুল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি মানবসমাজের প্রকৃত অবস্থা, গোত্রীয় গতিবিধি এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জাহিলি যুগের পাপাচার থেকে দূরত্ব
জাহিলি যুগের ঘনঘোর অন্ধকারেও তিনি তাঁর পবিত্রতা সর্বদা বজায় রেখেছিলেন। মদপায়ীদের মধ্যে বসবাস করেও তিনি কখনো মদ স্পর্শ করেননি, দেবদেবীর নামে উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত কখনো খাননি এবং মূর্তিপূজা সংশ্লিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানে তিনি কখনো অংশগ্রহণ করেননি। জীবনের প্রথম ধাপ থেকেই তিনি মিথ্যা উপাস্যদের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করতেন। লাত ও উজজার নামে শপথ করা তাঁর সহ্য হতো না। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি এতটাই পবিত্র ছিলেন যে, মূর্তির নামে কোরবানি করা পশুর গোশত থেকে তিনি সবসময় দূরে থাকতেন।
বিজ্ঞাপন
ঐশী সুরক্ষা ও নৈতিকতা
আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত ও হেফাজতে তাঁর লালন-পালন হয়েছে। ইবনে আসিরের বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুয়তপূর্ব জীবনেও জিহিলিয়্যাতের অনৈতিক কাজ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
একবার তিনি এক বালকের সাথে ছাগল চরাচ্ছিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি আমার ছাগল দেখো, আমি মক্কায় অন্য যুবকদের মতো কাব্যিক অনুষ্ঠানে অংশ নিই।’ কিন্তু মক্কায় পৌঁছতেই তিনি এক বিবাহ অনুষ্ঠানের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পেলেন। সেখানে বসতে যাচ্ছিলন-এমন সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর কানের শ্রবণশক্তি সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করে দিলেন এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সূর্যের তাপে ঘুম ভাঙার পর তিনি তাঁর সাথির কাছে ফিরে গিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। এরপর তিনি কখনো এ ধরনের কাজের কথা ভাবেননি।
সহিহ আল-বুখারিতে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের সময় তিনি এবং তাঁর চাচা আব্বাস (রা.) পাথর বহন করছিলেন। আব্বাস (রা.) তাঁকে পরামর্শ দিলেন যে, পাথরের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে তিনি যেন তাঁর লুঙ্গি কাঁধে রাখেন। কিন্তু তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরে পেয়েই তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘আমার লুঙ্গি, আমার লুঙ্গি!’ অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর থেকে তাঁর লজ্জাস্থান আর কখনো দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন: কোরআন নাজিলের প্রথম দিনটি যেমন কেটেছিল নবীজির
সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা
নবী কারিম (স.) ছিলেন সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতার জন্য সবাই তাঁকে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) হিসেবে অভিহিত করত। খাদিজা (রা.) তাঁর সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তিনি অভাবগ্রস্তদের বোঝা বহন করতেন, নিঃস্ব ও অসহায়দের সাহায্য করতেন, ন্যায্য দাবিদারদের সহায়তা করতেন এবং অতিথি আপ্যায়নে ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী।
মোটকথা, রাসলুল্লাহ (স.)-এর জীবন মানব ইতিহাসের পবিত্রতা, সততা ও নৈতিক উৎকর্ষের এক জীবন্ত দলিল। জাহিলি যুগের সমস্ত অন্ধকার ও পাপাচার থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন এবং তাঁর বিশুদ্ধতা ও উচ্চ নৈতিক মানদণ্ড সবসময় বজায় রেখেছিলেন। তাঁর জীবন শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অনুপম আদর্শ। আমাদের আজকের বিশ্বে যে নৈতিক সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তার সমাধান নিহিত রয়েছে এই মহামানবের শিক্ষা ও জীবনাদর্শে।
(ইবনে হিশাম, সিরাতুন নববিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৮: আল-হাকিম ও আজ-জাহাবি বর্ণিত হাদিস সহিহ বুখারি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪০; সহিহ বুখারি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩)

