নবুয়ত লাভের প্রায় তিন বছর আগে থেকে মহানবী (স.)-এর ভেতর নির্জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। তিনি হেরা গুহায় ইবাদত ও ধ্যান করতেন। বিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের অন্তরাল থেকে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহূর্তে সব কিছুকে জীবন, জীবিকা ও শক্তি জাগিয়ে চলেছেন, সেই মহামহিম সত্ত্বার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা তাঁর অন্তরে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত। মক্কা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত এই গুহার দৈর্ঘ্য ছিল চার গজ এবং প্রস্থ ছিল পৌনে দুই গজ। খাদিজা (রা.) কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গী হতেন।
তবে তিনি গুহায় অবস্থান না করে আশপাশে কোথাও অবস্থান করতেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ (স.) ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি পথিকদের পানি পান করাতেন এবং খাবার খাওয়াতেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৮৩)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যেমন কেটেছিল নবীজির যৌবন
রমজান মাসে কোরআন নাজিলের সূচনা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
বেশির ভাগ সিরাত রচয়িতার মতে, ১৭ রমজান (৬ আগস্ট ৬১০) কোরআন নাজিলের সূচনা হয়। এ সময় রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বয়স হয়েছিল ৪০ বছর ছয় মাস ১২ দিন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১২৪)
ওহি নাজিলের সূচনা সম্পর্কে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘হেরা গুহায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে (জিব্রাইল আ.) ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পাঠ করুন’। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, আমি বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না। তিনি (স.) বলেন, অতঃপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন চাপ দিলেন যে আমার খুব কষ্ট হলো। এভাবে তিনবার করার পর ছেড়ে দিয়ে বললেন—
বিজ্ঞাপন
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ‘যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে।’
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ‘পড়ুন, আর আপনার রব মহিমান্বিত।’
الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’
عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ ‘শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক: ১-৫)
আরও পড়ুন: কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেজা কীভাবে?
এ আয়াতগুলো নিয়ে আল্লাহর রাসুল (স.) ফিরে আসলেন। তাঁর হৃদয় তখন কাঁপছিল। তিনি খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের কাছে এসে বললেন, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত করো, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত করো। তিনি তাঁকে চাদর দ্বারা আবৃত করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত স্পন্দন প্রশমিত হলো। তিনি তাঁর সহধর্মিণীকে হেরা গুহার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং বললেন, আমি নিজেকে নিয়ে শঙ্কাবোধ করছি। খাদিজা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনোই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৩)
এরপর খাদিজা (রা.) তার চাচাত ভাই ওরাকা বিন নাওফালের কাছে নবীজিকে নিয়ে গেলেন। অন্ধকার যুগে ওরাকা বিন নাওফাল খ্রিস্টান ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন এবং ইবরানি ভাষা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। এক সময় তিনি ইবরানি ভাষায় কিতাব লিখতেন। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদিজা (রা.) তাকে বললেন, ‘ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। তিনি কী যেন সব কথাবার্তা বলছেন এবং অস্থির হয়ে পড়ছেন।’
ওরাকা বললেন, ‘ভাতিজা, বল তো তুমি কী দেখেছ? কী হয়েছে তোমার? রাসুলুল্লাহ (স.) যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং হেরা গুহায় যেভাবে যা ঘটেছিল সবকিছু সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। সবকিছু শোনার পর বিস্ময়-বিহ্বল কণ্ঠে ওরাকা বলে উঠলেন, ‘ইনিই তো সেই জন, যিনি মুসা (আ.)-এর কাছেও আগমন করেছিলেন।’ (তাবারি ২য় খণ্ড, পৃ-২০৭; ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ-২৩৭-২৩৮)
তারপর বলতে থাকলেন, ‘হায়! হায়! যেদিন আপনার স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোকেরা আপনার ওপর নানাভাবে অত্যাচার করবে এবং আপনাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে সেদিন যদি আমি শক্তিমান ও জীবিত থাকতাম।’ ওরাকার মুখে এ কথা শোনার পর রাসুলুল্লাহ (স.) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একী! ওরা আমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে?’ ওরাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা অবশ্যই আপনাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে।’ তিনি আরও বললেন ‘শুধু আপনিই নন, অতীতে এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। যখনই জনসমাজে কোনো সত্যের বার্তাবাহকের আবির্ভাব ঘটেছে তখনই তার গোত্রীয় লোকেরা নানাভাবে তার উপর জুলম, নির্যাতন চালিয়েছে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘মনে রাখুন আমি যদি সেই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকি তাহলে আপনাকে আমি সবরকম সাহায্য করব।’ কিন্তু এর কিছুকাল পরেই ওরাকা মৃত্যুবরণ করেন..। (সহিহ বুখারি, অধ্যায়-ওহি নাজিলের বর্ণনা, ১ম খণ্ড, পৃ- ২ ও ৪৩)
আরও পড়ুন: নবুয়তের আগেই নবীজিকে চিনেছেন যারা
বিস্ময়কর বিষয় হলো, একজন উম্মি (নিরক্ষর) নবীর ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহি ছিল ‘পাঠ করুন’। সাইয়েদ আবুল হাসান নদভি (রহ.) বলেন, ‘প্রথম অবতীর্ণ ওহিতে কলমের উল্লেখ যা একজন নিরক্ষর লোকের ওপর, একটি নিরক্ষর জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি দেশে নাজিল হলো, যেখানে কলমের অস্থিত্ব কদাচিৎ পাওয়া যেত। যেখানে লেখাপড়া জানা লোক আঙুলে গোনা যেত, তা এই ধর্ম ও এর ধারক-বাহক উম্মতের লেখাপড়া ও কলমের সাহায্যে কাজ করার যোগ্যতা এবং এর দ্বারা তার চিরস্থায়ী ও মজবুত সম্পর্ক চিহ্নিত করে দিয়েছে।’ (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১২৪)
আর মহানবী (স.)-এর উম্মি বা নিরক্ষর হওয়ার রহস্য সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি এর আগে কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বহস্তে কোনো কিতাব লেখেননি যে মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।’ (সুরা আনকাবুত: ৪৮)
সুরা আলাকের পাঁচটি আয়াত ছিল প্রথম নাজিলকৃত ওহি। এভাবে জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মহানবী মুহম্মদ (স.)-এর প্রতি পুরো কোরআন নাজিল সম্পন্ন হয়।
পবিত্র কোরআনুল কারিম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ। বিশ্বমানবতার চিরন্তন মুক্তির সনদ, যার অধ্যয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ ও সফলতা। ইসলামি মূলনীতির প্রথম ও প্রধান উৎস হলো আল কোরআন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা ও সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

