নবীজির জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যতম অলৌকিক ঘটনা প্রিয়নবীজির বক্ষ বিদারণ। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা নবীজির বুক চিরে অলৌকিক শক্তির প্রতিস্থাপন করেন। এই ঘটনাকে আরবিতে সাক্কুস-সাদরি তথা বক্ষ বিদারণ বলে। আল্লামা ইদরিস কান্ধলভি (রহ.)-এর বর্ণনামতে, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনে চারবার বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটে। প্রথমবার চার বছর, মতান্তরে পাঁচ বছর বয়সে, দ্বিতীয়বার ২০ বছর বয়সে, তৃতীয়বার নবুয়ত লাভের সময়, চতুর্থবার ইসরা বা ঊর্ধ্ব গমনের সময়। (সিরাতে মোস্তফা: ১/৭৫)
প্রথমবার বক্ষ বিদারণ
প্রথমবার বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটেছিল যখন নবীজি হালিমা সাদিয়ার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এই বক্ষ বিদারণের রহস্য ছিল তাঁর কলবকে পবিত্র ও অন্যায় প্রবণতা থেকে মুক্ত করে দেওয়া, যাতে পাপ প্রবণতার শেষ চিহ্ন পবিত্র কলবে অবশিষ্ট না থাকে। শিশু নবীজি যখন দুধ ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিলেন, তখন জিবরাইল ফেরেশতা এসে নবীজির বক্ষ বিদীর্ণ করেন; হৃদপিণ্ড বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করেন। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) এলেন, তখন তিনি শিশুদের সঙ্গে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৃৎপিণ্ড বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিণ্ড বের করলেন এবং বলেন, এ অংশ শয়তানের। এরপর হৃৎপিণ্ড একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তাঁর অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করলেন। তখন ওই শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধ মায়ের কাছে গেল এবং বলল, মুহাম্মদ (স.)-কে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বক্ষে সে সেলাইয়ের চিহ্ন দেখেছি। (মুসলিম: ৩১০)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: শিশু মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে দুধমা হালিমার চমকপ্রদ বর্ণনা
দ্বিতীয়বার বক্ষ বিদারণ
দ্বিতীয়বার ১০ বা ২০ বছর বয়সে এক ময়দানে জিবরাইল (আ.) ও মিকাইল (আ.) তাঁকে শোয়ায়ে বক্ষ বিদারণ করেন। এতে কোনো রক্ত বের হয়নি। কোনো কষ্টও অনুভব করেননি। তখন একজন পানি আনয়ন করেন, দ্বিতীয়জন কলব ধৌত করেন। এটা দ্বারা হিংসা-বিদ্বেষকে একটি রক্তপিণ্ডের মতো বের করে ফেলে দেন। আর স্নেহ-মমতাকে রৌপ্যের টুকরার মতো একটি পিণ্ড আকারে অন্তরে প্রবিষ্ট করিয়ে দেন। অতঃপর বক্ষ বন্ধ করে তাতে একটি জিনিস ওষুধের মতো লাগিয়ে দেন। এরপর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অন্তরে স্নেহ-মমতা, দয়া ও অনুগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে। আর যৌবনের সর্বপ্রকার কু-বাসনা দূর হয়ে যায়। (তাফসিরে জালালাইন: ৭/৫০৬)
তৃতীয়বার বক্ষ বিদারণ
নবীজির তৃতীয়বার হয় হেরা গুহায়। তা এজন্য যে পবিত্র কলব ওহির রহস্য ও আল্লাহর ইলম গ্রহণ এবং বহনে যেন সক্ষম হয়। (সীরাতে মুস্তফা: ১/৮০)
বিজ্ঞাপন
চতুর্থবার বক্ষ বিদারণ
নবীজির চতুর্থবার বক্ষ বিদারণ হয় মেরাজে গমনের সময় বক্ষ বিদারণ করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল যে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পবিত্র কলব যাতে ফেরেশতাজগতে ভ্রমণ, আল্লাহর নিদর্শন পর্যবেক্ষণ ও আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতার অধিকারী হয়। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমার কাছে ফেরেশতা আসলেন এবং তাঁরা আমাকে নিয়ে জমজমে গেলেন। আমার বক্ষ বিদীর্ণ করা হলো। তারপর জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে আমাকে নির্ধারিত স্থানে ফিরিয়ে আনা হলো। (বুখারি: ৩৬০৮)
এভাবে বারবার বক্ষ বিদারণ করে আল্লাহ তাআলা দৈহিক ও আত্মিকভাবে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বক্ষ উন্মুক্ত ও সম্প্রসারিত করেছেন। বক্ষ বিদারণের পর সুস্থ-স্বাভাবিক থাকা এবং শরীরে কোনো চিহ্ন না থাকা সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘এটি আলমে মিসাল (উপমা ও আধ্যাত্মিক জগৎ) ও আলমে শাহাদাতের (দৃশ্যমান জগৎ) মধ্যবর্তী ঘটনা। এই বুক চিরে ফেলা সে ধরনের জিনিস না, যা ক্ষতির কারণ হয়। সেলাইয়ের কোনো চিহ্ন তাঁর বুকে ছিল না। আমলে মিসাল ও আলমে শাহাদাত যেখানে মিলিত হয়, সেখানে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা: ২/১০৫)

