সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ইসলামি নিয়ম-কানুন যা সবার জানা দরকার

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ জুন ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ইসলামি নিয়ম-কানুন যা সবার জানা দরকার

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম—এসব প্ল্যাটফর্মে আমরা প্রতিদিন অনেক সময় ব্যয় করি। এখান থেকে যেমন জ্ঞান, যোগাযোগ ও বিনোদন মিলছে, তেমনি কিছু বিপদও তৈরি হচ্ছে। যেমন সময় অপচয়, গিবত, অপসংস্কৃতি ছড়ানো, অহংকার প্রদর্শন, গোপনীয়তা লঙ্ঘন ইত্যাদি।

ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেরও নির্দেশনা রয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে—সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কি ইসলামে নিষেধ? উত্তর—না। তবে এর ব্যবহার হতে হবে শালীনতা, সততা ও ইসলামের নীতিমালার আলোকে। নিচে ইসলামিক দৃষ্টিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।


বিজ্ঞাপন


১. সময়ের অপচয় নয়

ইসলামে সময়কে মহান নেয়ামত বলা হয়েছে। নবী করিম (স.) বলেন- ‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে দুটোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর।।’ (বুখারি: ৬৪১২)
ফেসবুক বা ইউটিউব স্ক্রল করতে করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করে ফেললে সেটি আল্লাহর দেয়া সময়ের অপচয় হিসেবে গণ্য হবে। কাজেই সময় নির্ধারণ করে সীমিতভাবে ব্যবহার করুন।

২. গিবত ও অপবাদ থেকে বিরত থাকুন

ইন্টারনেটে কাউকে কটাক্ষ, বিদ্রূপ বা অপমান করে পোস্ট, কমেন্ট বা ভিডিও দেওয়া সবই গিবতের শামিল। কোরআনে গিবত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘তোমরা একে অপরের গিবত করো না। এটা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো জঘন্য।’ (সুরা হুজরাত: ১২)
তাই অনলাইনে কাউকে অপমান করা, অন্যের দোষ খোঁজা বা গুজব ছড়ানো ইসলামি আদবের লঙ্ঘন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ৬ ক্ষেত্রে গিবত জায়েজ

৩. অশ্লীল কনটেন্ট এড়িয়ে চলুন

ইসলামে পর্দা ও শালীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অশ্লীল ছবি, গান, ভিডিও, অথবা যেসব কনটেন্ট মানুষকে গুনাহের দিকে টানে, তা দেখা বা শেয়ার করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোরআনে আল্লাহ বলেন- ‘ফাহেশা (অশ্লীলতা) ও মন্দ কাজের ধারেকাছেও যেয়ো না।’ (সুরা আনআম: ১৫১)

৪. অহংকার ও আত্মপ্রদর্শন বর্জন করুন

নিজের সাফল্য, সৌন্দর্য বা সম্পদের অহংকারমূলক প্রদর্শন করা অনলাইনেও গুনাহ। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (জামে তিরমিজি: ১৯৯৮)
আত্মপ্রদর্শন বা রিয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। কেউ হীনমন্যতায় ভুগতে পারে—এমন কনটেন্ট থেকেও বিরত থাকা ইসলামি শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত।

৫. সত্য ও ভালো জিনিস শেয়ার করুন

নবী করিম (স.) বলেছেন- ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১)
তাই ইসলাম, জ্ঞান বা নৈতিক শিক্ষা বিষয়ক ভালো কিছু শেয়ার করা অবশ্যই সওয়াবের কাজ। তবে শেয়ার করার আগে সত্যতা যাচাই জরুরি। কারণ, মিথ্যা তথ্য ছড়ানোও গুনাহ। একই হাদিসেই নবীজি বলছেন, যে কেউ ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামকেই তার ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নিল। (বুখারি: ৩৪৬১)

আরও পড়ুন: হাদিস পড়লে প্রতি হরফে সওয়াব হবে কি?

৬. গোপনীয়তা ও শালীনতা রক্ষা করুন

নিজের বা পরিবারের ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, জীবনযাপন বা সম্পর্ক সামাজিক মাধ্যমে বেশি প্রকাশ করা ইসলাম পরিপন্থি কাজ। এতে ব্যক্তিগত জীবন উন্মুক্ত হয় এবং অনেক সময় তা বিপদের কারণ হয়। ইসলাম এসব অনুমোদন করে না। আর কেউ যদি নিজের পরিবারের অশ্লীল বিষয়গুলো মেনে নেয়, হাদিসের ভাষায় সে দাইয়ুস। রাসুলুল্লাহ (স.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা যখন জান্নাত সৃষ্টি করেছেন তখন জান্নাতকে বলেছেন, আমার সম্মান-গৌরব ও পরাক্রমশালীর শপথ! কৃপণ, মিথ্যাবাদী এবং দাইয়ুস ব্যক্তি তোমার মধ্যে প্রবেশ করবে না। (নাসায়ি, জাকাত অনুচ্ছেদ: ২৫৬২; মুসনাদে আহমদ: ২/১৩৪)

৭. হাস্যরস যেন কটাক্ষ বা অপমানজনক না হয়

অনেক সময় মজার ভিডিও বা পোস্ট করার নামে অন্যকে অপমান করা হয়। ইসলামে কাউকে কষ্ট দেওয়া বা অপমান করা হারাম, এমনকি দুষ্টুমি করেও। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির মন্দ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করে।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২১৩)

আরও পড়ুন: অন্যকে নিয়ে হাসাহাসি করার গুনাহ

৮. পর্দা বজায় রাখুন

নারী-পুরুষের অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, ভিডিও কল, ইনবক্সিং ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব স্বাভাবিক হলেও, ইসলামি দৃষ্টিতে এসব প্রয়োজনসাপেক্ষ হওয়া জরুরি। পর্দা মেনে চলার ব্যাপারে কোরআন হাদিসে অনেক সতর্কতা রয়েছে। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। (তিরমিজি: ১১৭৩) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের  স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারাই, যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে।’ (বায়হাকি: ১৩২৫৬)

৯. ঈমান ও আমল বৃদ্ধি হয় এমন কনটেন্ট ফলো করুন

পছন্দের কনটেন্ট বা ইউটিউব চ্যানেল বেছে নেওয়ার সময় খেয়াল রাখুন—এগুলো কি আপনাকে আল্লাহর দিকে টানে, নাকি দুনিয়ার মোহে ভাসিয়ে দেয়? বর্তমান যুগে অনলাইন ফিতনায় ভরপুর। হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামতের আগে অন্ধকার রাতের ন্যায় এমন ভয়াবহ ফিতনা একের পর এক আসতে থাকবে যে মানুষ সকালে ঈমানদার থাকবে তো বিকেলে কাফের হয়ে যাবে, বিকেলে ঈমানদার থাকবে তো সকালে কাফের হয়ে যাবে।’ (আবু দাউদ: ৪২৫৯)

তাই আমরা প্রত্যেকে শুধু নামকাওয়াস্তে ঈমানদার হব না। আমাদের উচিত, নিজের সংশোধনে মনোযোগী হওয়া।

১০. সাইবার অপরাধ বা প্রতারণা থেকে সাবধান থাকুন

মিথ্যা পরিচয়ে প্রতারণা, ভুয়া আইডি খুলে কারও ক্ষতি করা, গোপনে স্ক্রিনশট নেওয়া বা অন্যের সম্মানহানি—এসবই ইসলামে হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নবীজি বলেছেন, ‘প্রতারণাকারী ও ধোঁকাবাজকারীদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ (তিরমিজি: ১৩১৫ )

শেষ কথা, সোশ্যাল মিডিয়া যেমন দাওয়াত ও আত্মশুদ্ধির হাতিয়ার হতে পারে, তেমনি হতে পারে গুনাহের মাধ্যমও। আল্লাহ বলেন— ‘তোমাদের কেউ তিল পরিমাণ ভালো কাজ করলে তা সে দেখবে, আর তিল পরিমাণ মন্দ কাজ করলেও তা সে দেখবে।’ (সুরা জিলজাল: ৬-৮)

আসুন, অনলাইনেও ইসলামের আলোকে চলি। সততা, শালীনতা ও সুবিচার হোক আমাদের ডিজিটাল পরিচয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর