কোরবানি শুধু পশু জবাইয়ের নাম নয়; এটি এমন ইবাদত, যার সঙ্গে সমাজের দরিদ্র ও অভাবিদের অধিকার জড়িত। অনেকে প্রশ্ন করেন—গরিবদের কোরবানির গোশত না দিলে কি কোরবানি সহিহ হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দলিল ও ফিকহি ব্যাখ্যার আলোকে জানা জরুরি।
কোরবানি ও সামাজিক দায়িত্ব
কোরবানি ইসলামের এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার পরতে পরতে রয়েছে ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগের শিক্ষা। এই উম্মতের সামর্থ্যবানদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন— فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার: ২) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের (কোরবানির পশুর) গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের ‘তাকওয়াই’ পৌঁছে।’ (সুরা হজ: ৩৭)
এসব আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরবানি শুধু পশু জবাই করার নাম নয়; বরং এর সঙ্গে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম-কানুন ও অধিকার। যা পালন করলে ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত যথাযথ পালন হবে।
কোরআন-হাদিসে কোরবানির গোশত বণ্টনের নির্দেশনা
আল্লাহ তাআলা বলেন— فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ ‘সেখানে থেকে নিজেরাও খাও এবং নিঃস্ব দরিদ্রদেরও খাওয়াও।’ (সুরা হজ: ২৮) এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরবানির গোশত নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি দরিদ্রদের মধ্যেও বিতরণ করা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
বিজ্ঞাপন
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছে- كُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا ‘তোমরা (কোরবানির গোশত) খাও, জমা রাখো ও সদকা করো।’ (সহিহ মুসলিম: ১৯৭১) এখানে তিনটি কাজের কথা বলা হয়েছে: ১. খাওয়া ২. সংরক্ষণ করা ৩. দান করা। এই তিনটি দিক থেকে বোঝা যায় যে কোরবানির গোশতের একটি অংশ গরিবদের জন্য নির্ধারিত হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: ১০ কারণে কোরবানি শুদ্ধ হয় না
গরিবদের না দিলে কোরবানি সহিহ হবে কি?
হানাফি মাজহাব মতে, কোরবানির পুরো মাংস যদি কেউ নিজে রেখে দেয়, তাতেও কোনও অসুবিধা নেই; কোরবানি শুদ্ধ হবে। তবে, এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪; আলমগিরি: ৫/৩০০)
ধনীদের সম্পদে গরিবের হক
শুধু কোরবানি নয়, যেকোনো মৌসুমে, যেকোনো আয়োজন-উৎসবে গরিবদের শামিল করা প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তাদেরকে অন্তত ঈদের সময় বঞ্চিত করা অনুচিত। তা সমাজে ধনী-গরিব বৈষম্য বেড়ে যাওয়ারও কারণ হতে পারে। পবিত্র কোরআনে গরিবের হক সম্পর্কে এসেছে— وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে প্রশ্নকারী ও বঞ্চিতদের হক।’ (সুরা জারিয়াত: ১৯)
আরও পড়ুন: গরিবদের হয়ে আল্লাহ ধনীদের যে প্রশ্ন করবেন
তাই বিত্তবানরা সুখে-দুঃখে সমাজের কল্যাণে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবায় এগিয়ে আসবেন—এটাই ধর্ম ও মানবতার দাবি। অতএব, কোরবানির গোশত গরিবদের না দিলে আপনার কোরবানি আদায় হলেও এই ইবাদত সৌন্দর্য ও সুন্নতে পরিপূর্ণ হবে না—এটি নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়।
মোদ্দাকথা, গরিবদের গোশত না দিলেও কোরবানি সহিহ হবে, তবে তা আদর্শ কোরবানি হবে না। মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আ.) ও মহানবী (স.)-এর আদর্শ অনুযায়ী, কোরবানির উদ্দেশ্য কেবল ইবাদত নয়; বরং সমাজে দয়া ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা। আর এ দয়া ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, গরিব-দুঃখি ও আত্মীয় স্বজনদের দিলে। এতে ঈদের আনন্দে তারাও শরিক হয় এবং একইসঙ্গে নিজের কোরবানিও পূর্ণতা পায়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরবানির সকল সুন্নত যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

