প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় মুসলিম উম্মাহ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করে। এই কোরবানির অংশ হিসেবে পশুর চামড়া একটি দামী সম্পদ—যা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক নয়, বরং ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, দরিদ্রদের কল্যাণ ও সমাজের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, বর্তমানে এ চামড়া ব্যাপকভাবে অবহেলিত ও অপচয় হচ্ছে।
কোরবানির পশুর চামড়ার বিধান
ইসলামে কোরবানির চামড়ার হকদার গরিব ও অসহায়রা। এক কথায় চামড়া বা চামড়া বিক্রির সমুদয় টাকা জাকাতের হকদারদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। পবিত্র কোরআানে মহান আল্লাহ বলেন- إِنَّمَا ٱلصَّدَقَـٰتُ لِلۡفُقَرَاۤءِ وَٱلۡمَسَـٰكِینِ وَٱلۡعَـٰمِلِینَ عَلَیۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِی ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَـٰرِمِینَ وَفِی سَبِیلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِیلِۖ فَرِیضَةࣰ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِیمٌ حَكِیمࣱ অর্থ: ‘সদকা হল শুধু নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, সদকা বা জাকাত আদায়কারী কর্মচারী ও যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য এবং তা (সেই) ক্রীতদাস (যার) মুক্তির জন্যে (অর্থের প্রয়োজন), ঋণগ্রস্তদের জন্যে (যারা এমন গরিব যে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না), আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তাওবা: ৬০)
কোরবানির চামড়া বিক্রি নিয়ে ইসলাম কী বলে
কোরবানির চামড়া বিক্রি করে নিজের কোনো কাজ চালানো ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, ‘যে তার কোরবানির চামড়া (নিজের জন্য) বিক্রি করবে, তার কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (জামে সগির: ৮৫৩৫ মুসতাদরাকে হাকেম: ৩৪৬৮ বায়হাকি: ১৯৭০৮, হাদিস সহিহ)
বিজ্ঞাপন
অবশ্য মূল্য সদকা করার নিয়তে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা যাবে। এক্ষেত্রে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েজ ও গুনাহ। নিয়ত যা-ই হোক, বিক্রি করে দিলে পুরো অর্থই সদকা করে দেওয়া জরুরি। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩০১; কাজিখান: ৩/৩৫৪) তবে, সেই চামড়া দিয়ে নিজে উপকৃত হওয়া জায়েজ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরবানির পশুর চামড়া দ্বারা উপকৃত হও; তবে বিক্রি করে দিও না।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ খণ্ড: ৪ পৃ-২৯)
কোরবানির চামড়া মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দেওয়া যাবে?
কোরবানির চামড়ার অর্থ পাওয়ার হকদার হলো জাকাত ও ফিতরার উপযুক্ত ব্যক্তিরা। তাই এক্ষেত্রে দরিদ্র তালিবে ইলমকেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া যাবে। ইলমে দ্বীনের দরিদ্র শিক্ষার্থীকে জাকাত, ফিতরা ও কোরবানির চামড়ার মূল্য প্রদানে বরং বেশি সওয়াব আছে। কেননা কোরআনে বর্ণিত জাকাত-দান-সদকার একটি খাত হলো—ফি সাবিলিল্লাহ। জিহাদরত মুজাহিদ, হজের সফরে থাকা দরিদ্র ও ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দরিদ্ররা এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। (দুররুল মুখতার: ৩৪৩, হেদায়া: ১/১৮৫, রুহুল মাআনি: ৬/৩১৩)
বর্তমান চিত্র: অপচয় ও অনাদরের শিকার
বর্তমানে অনেক জায়গায় দেখা যায়, দর হ্রাস পাওয়ার কারণে চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। কোথাও ফেলে দেওয়া হয়, কোথাও আগুনে পোড়ানো হয়। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, বরং আল্লাহর এক নেয়ামতের অপচয় হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা আরাফ: ৩১)
চামড়ার যথাযথ সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহারে অবহেলা করা এক ধরনের গাফলতি এবং তা ইসলামি নীতিমালার পরিপন্থী।
আরও পড়ুন: পশুর চামড়া খাওয়া কি জায়েজ?
ইসলামি প্রতিষ্ঠানের বিকল্প আর্থিক উৎস হতে পারে
বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখ লাখ কোরবানির পশু জবেহ হয়। এই বিপুল চামড়া সঠিকভাবে সংগৃহীত ও ব্যবস্থাপনা করা হলে তা অসংখ্য মাদ্রাসা ও এতিমখানার খরচ চালাতে সাহায্য করতে পারে। দরিদ্র ছাত্রদের নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি ও কল্যাণের উপায় হতে পারে।
করণীয় কী?
চামড়া ফেলে না দিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসা, এতিমখানা বা বিশ্বস্ত ধর্মীয় সংস্থায় দিন।
চামড়া সংরক্ষণে লবণ ব্যবহার করে দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করুন।
চামড়া যারা সংগ্রহ করে, তাদের প্রতি সদয় হোন এবং এ কাজকে একটি আমানত মনে করুন।
প্রশাসন এবং সমাজ—উভয়ের সমন্বয়ে চামড়া সংগ্রহে স্বচ্ছতা আনুন।
শেষ কথা, কোরবানির চামড়া শুধু পশুর চামড়া নয়—এটি একটি ইসলামি সম্পদ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক এবং দরিদ্রদের হক। একে অবহেলা নয়, বরং আমানত হিসেবে দেখা উচিত। কোরবানির এই অমূল্য অংশকে যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাই, তবে তা কেবল ধর্মীয়ভাবে নয়, সমাজিকভাবেও একটি বিপ্লব আনতে পারে।

