মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হিজরতের রাতের নীরব নায়ক আলী (রা.)-এর কোরবানি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

হিজরতের রাতের নীরব নায়ক আলী (রা.)-এর কোরবানি

মক্কার আকাশে তখন ষড়যন্ত্রের অন্ধকার। চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরছে খুনের পরিকল্পনা। মুহূর্তেই ঝরে যেতে পারত এক পবিত্র প্রাণ—যাঁকে ছাড়া ইসলামের ভবিষ্যৎ কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু ঠিক সেই সময়, একজন সাহসী তরুণ নিঃশব্দে শুয়ে পড়লেন সেই ঝুঁকির বিছানায়। তিনি জানতেন, ভোর না-ও দেখতে পারেন। তবুও একটুও কাঁপলেন না।

এই নীরব বিপ্লবীর নাম—হজরত আলী (রা.)। হিজরতের রাতে তাঁর আত্মত্যাগ শুধু ইতিহাস নয়, তা এক জীবন্ত আদর্শ। এই প্রতিবেদনে জানব, কীভাবে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করেছিলেন রাসুল (স.)-কে এবং নির্মাণ করেছিলেন ইসলামের নব দিগন্ত।


বিজ্ঞাপন


সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি হজরত আলী (রা.)

মক্কার কুরাইশ নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা রাতের আঁধারে একযোগে ঘরে ঢুকে নবী মুহাম্মদ (স.)-কে হত্যা করবে। আল্লাহর আদেশে নবী (স.) তখন মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রিয়নবী (স.) হজরত আলী (রা.)-কে বললেন, তুমি আমার এই সবুজ হাদরামি চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাকো। ওদের হাতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। প্রিয়নবী (স.) এই চাদর গায়ে জড়িয়ে রাতে ঘুমাতেন। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮২, ৪৮৩)

আরও পড়ুন: সালমান ফারসির ইসলামগ্রহণ, সত্যান্বেষীর জন্য দৃষ্টান্ত

হজরত আলী (রা.) সাহসের সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন এবং পুরো রাত নবীজির চাদর মুড়ে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকেন। এরপর রাসুলুল্লাহ (স.) এক মুঠো ধুলো নিয়ে বাইরে এলেন এবং কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। এতেই আল্লাহ তাআলা তাদের অন্ধ করে দিলেন। ফলে তারা আল্লাহর রাসুলকে দেখতে পেল না। সেসময় নবীজি (স.) এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন যে ‘আমি ওদের সামনে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপন করছি এবং ওদেরকে আবৃত করছি। ফলে ওরা দেখতে পায় না।’ (সুরা ইয়াসিন: ৯) প্রত্যেকের মাথায় নিক্ষিপ্ত ধুলোবালি গিয়ে পড়ল। এরপর তাদের ওই অন্ধ অবস্থায় তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁৎ পেতে থাকা লোকগুলো কেউ কিছুই দেখতে পেল না। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮৩; জাদুল মাআদ: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-৫২)


বিজ্ঞাপন


কুরাইশদের চোখের সামনে এক মহাসত্য

মক্কার কাফের নেতারা নবী (স.)-কে হত্যা করতে ঘেরাও করে রেখেছিল ঘরটি। নবীজির প্রস্থানের খবর তারা টের পেল না। পরে তারা ঘরে প্রবেশ করল। তারা ভেবেছিল মুহাম্মদ (স.) ঘরে শুয়ে আছেন। কিন্তু দেখতে পেলো- নবীজির চাঁদর মুড়িয়ে শুয়ে আছেন আরেকজন। তিনি আলী (রা.)। মূলত তাদের বিভ্রান্ত করে নবীজি নিরাপদে হজরত আবু বকরের ঘরে গিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ততক্ষণে হিজরত শুরু করে দিয়েছেন। সীরাতে এসেছে, আলী (রা.)- এর সেদিনের সাহস এবং দৃঢ়তার কারণে নবী (স.) নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। যা বুঝতে পেরে কুরাইশরা হতাশ হয়ে ফিরে যায় কারণ তারা নবী (স.)-কে ধরতে পারেনি। এখানে এক মহাসত্য লুকিয়ে আছে যে, আল্লাহ  ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। তিনি যাকে বাঁচাতে চান, কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। প্রিয়নবী (স.)-কে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী!) আপনি ওই সময়টি স্মরণ করুন, যখন কাফেররা চক্রান্ত আঁটছিল যে, তারা আপনাকে বন্দী করবে, অথবা হত্যা করবে কিংবা করবে দেশান্তর। তারা তাদের ষড়যন্ত্র করছিল আর আল্লাহ আপন কৌশল করছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী। (সুরা আনফাল: ৩০)

আরও পড়ুন: দাজ্জালের সঙ্গে সাক্ষাতের যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তামিম দারি (রা.)

ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে আলী (রা.)

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক, আল-তাবারি, আবু নুযরাহ প্রমুখ আলী (রা.)-এর এই ভূমিকাকে ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তারা তাঁকে ‘নীরব নায়ক’ আখ্যা দেন। (আবু নুযরাহ, ইসলামি ইতিহাস, পৃ. ৮৯; আল-রাব্বানি, ইসলামি ইতিহাস ও গবেষণা, ৩/৭৮)

আলী (রা.)-র নিঃশব্দ বিজয় ও ইসলামের নবযাত্রা

আলী (রা.)-এর এই ত্যাগ ও কৌশলী ভূমিকা নবী (স.)-এর নিরাপদ হিজরত নিশ্চিত করেছিল। এই রাত ছিল ইসলাম রক্ষার এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

সাহস, ধৈর্য্য ও ত্যাগের শিক্ষা

আলী (রা.)-এর এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আজকের মুসলিম সমাজের জন্য এক অমূল্য শিক্ষা। সংকটের মুহূর্তে ভয় নয়, বরং বিচক্ষণতা, ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই হওয়া উচিত প্রতিক্রিয়ার ভাষা।

এক মহান কীর্তির চিরন্তন আলো

হিজরতের রাতে হজরত আলী (রা.)-এর নিঃশব্দ ত্যাগ শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততার এক মহান গাথা। নবী (স.)-র নিরাপত্তার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে আলী (রা.) ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। এই মহাকাব্যের নীরব নায়ক আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণার এক অপার উৎস।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর