সত্য দ্বীনের খোঁজে হজরত সালমান ফারসির (রা.) ত্যাগস্বীকার ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাকে মুক্ত করতে প্রিয়নবী (স.)-এর পক্ষ থেকে এক জলন্ত মোজেযা প্রকাশ হয়েছিল। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, সালমান ফারসি (রা.) নিজের মুখে তাকে নিচের গল্পটি বলেছেন—
আমি ছিলাম এক পারসিয়ান। ইস্পাহানের জায়্য নামের এক গ্রামের লোক আমি। আমার বাবা ছিলেন গ্রামের সর্দার। বাবার কাছে আমি ছিলাম আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র। তিনি আমাকে এতই পছন্দ করতেন যে, সবসময় চোখের সামনে রাখতেন। কখনো ঘরছাড়া হতে দিতেন না। আগুনের কাছেই রাখতেন, ঠিক মেয়েদের মতো। আমি অগ্নিপূজকদের ধর্মে কঠোর সাধনা করতাম।
বিজ্ঞাপন
পরে আমি তাদের পবিত্র আগুনের রক্ষাকারী হয়ে যাই। আমি সারাদিন সেই আগুন দেখাশোনা করতাম, যেন ওটা কখনো নিভে না যায়। আমার বাবার বিশাল বাগান ছিল। একদিন তিনি কিছু নির্মাণকাজে খুব ব্যস্ত থাকাতে আমাকে বললেন, ‘সালমান, আমি এই বাড়ির কাজ নিয়ে আজ খুব ব্যস্ত, তুমি আজকে বাগানে যাও, আর কিছু কাজ করে আসো’, কী কী কাজ করার ছিল, তা তিনি আমাকে বলে দিলেন। এরপর আমি বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে এক খ্রিস্টান চার্চ চোখে পড়ল। তাদের প্রার্থনার আওয়াজ আসছিল আমার কানে।
বাসায় বন্দী থাকাতে বাইরের পৃথিবীর ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল না বললেই চলে। তাই পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাদের প্রার্থনার শব্দ শুনে আমি ওখানে ঢুকে পড়ি। তাদের প্রার্থনা আর ধর্ম দেখে আমি তাদের ব্যাপারে আগ্রহী হলাম। আল্লাহর শপথ! আমার মনে হলো, এই ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই থেকে গেলাম। বাবার কথাগুলো ভুলে গেলাম! আর বাগানে যাওয়াই হলো না। এই ধর্মের আদিস্থান কোথায়, তা তাদের জিজ্ঞেস করলাম। তারা সিরিয়ার কথা বললেন। এরপর আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যাই।
এদিকে উনি চারিদিকে লোক পাঠিয়ে আমাকে খুঁজছিলেন। ফলে তার সারাদিনের কাজ ভেস্তে গেল। ফেরার পর তিনি আমাকে বললেন, ‘সালমান, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি তোমাকে কিছু কাজ দিয়েছিলাম; ওগুলো করনি?’ আমি বললাম, ‘গির্জাতে প্রার্থনারত কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাদের ধর্মে যা দেখলাম, তা আমার মনে দাগ কাটল। আল্লাহর শপথ! সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গেই ছিলাম। তিনি বললেন, ‘ও আমার সন্তান! ওই ধর্মে কোনো ভালো কিছু নেই। তোমার আর তোমার বাপ-দাদার ধর্মই বেশি ভালো’। আমি বললাম, ‘না, আল্লাহর শপথ! আমি যা দেখেছি, তা আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো’। উনি আমার কথায় বেশ ঘাবড়ে গেলেন, আর আমার পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে বাসায় বন্দী করে রাখলেন।
আমি গির্জার সেই খ্রিস্টানদের খবর পাঠালাম—সিরিয়া থেকে কোনো ব্যবসায়ী কাফেলা আসলে, তারা যেন আমাকে জানায়। তাদের একজন আমাকে জানাল, তাদের কাছে সিরিয়া থেকে সত্যিই এক কাফেলা এসেছে কয়েকদিন আগে। তাদেরকে আমার কথাও তারা জানিয়েছে। আমি তাকে বললাম, কাজ শেষে যখন ওরা দেশে ফিরবে, তখন যেন আমাকে খবর দেয়। পরে ওদের যখন যাওয়ার সময় হলো, তখন তারা আমাকে খবর দিল। আমিও আমার পায়ের শিকল খুলে ছুড়ে ফেললাম, আর ওই কাফেলার সঙ্গে চললাম; একেবারে সিরিয়া পর্যন্ত চলে এলাম।
বিজ্ঞাপন
সিরিয়া পৌঁছার পর আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই ধর্মে সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি কে? তারা বলল, ‘চার্চের বিশপ।’ আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনাদের ধর্ম আমার ভালো লেগেছে। আমি আপনার সঙ্গে থেকে চার্চের সেবা করতে চাই, এতে আপনার কাছে ধর্মের শিক্ষাও অর্জন হবে, প্রার্থনাও করা যাবে।’ তিনি এতে সায় দিলেন, আমিও তার সঙ্গে রয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি ছিল খুব মন্দ প্রকৃতির। তিনি চার্চের অনুসারীদের দানশীলতার আদেশ আর উৎসাহ দিতেন; অথচ সেই দানের টাকার বেশিরভাগ উনি গরিবদের না দিয়ে নিজের জন্য রেখে দিতেন। এভাবে তার সাতটা সিন্দুকে সমান সোনা-রূপা জমা হলো।
তার কাজকর্মে আমি তাকে যারপর নাই ঘৃণা করতাম। একদিন তিনি মারা গেলেন। ওখানকার খ্রিস্টানরা তাকে কবর দেয়ার জন্য আসল। আমি তাদের বললাম, সে একজন মন্দ লোক ছিল; তোমাদের সে দানশীলতার আদেশ আর উৎসাহ দিত, অথচ তোমাদের দানের পুরোটাই সে নিজের জন্য রেখে দিত, কোনো অংশই সে গরিবদের দিত না’। তারা বলল, ‘এর প্রমাণ কী? তার সে সম্পদ কোথায় আছে দেখাও আমাদের!’ আমি তাদের দেখিয়ে দিলাম আর বের হয়ে আসলো তার লুকানো সেই সাতটা সিন্দুক; সোনা-রূপায় ভরা। তারা সবাই বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা এই লোককে কবর দেব না।’ তারা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে পাথর ছুড়ল।
এরপর তারা ওই পদে নতুন এক লোক নিয়োগ দিল। তিনি দুনিয়াত্যাগী আর পরকালপ্রত্যাশী ছিলেন। তার দ্বিননদারির কোনো তুলনাই ছিল না; তার চেয়ে ভালো করে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে—এমন কাউকে আমি কখনো দেখিনি। তাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতাম; এমনটা আর কারো জন্য আমি অনুভব করিনি। তার সঙ্গে আমি বেশ কিছুদিন ছিলাম। তারপর যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো, আমি বললাম, ‘ও শায়খ! আমি আপনার সঙ্গে ছিলাম। আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি, যেমনটা আগে আর কখনো হয়নি। এখন আল্লাহর ফরমান আপনার কাছে চলে এসেছে। আপনি আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দেন? কি করার আদেশ দেন?’
তিনি বললেন, ‘ও আমার সন্তান! এমন কারো নাম তো মনে আসছে না, যে আমার এই পথ অনুসরণ করে। লোকেরা ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। সবাই বদলে গেছে আর ধর্মকে ত্যাগ করেছে। তবে, একজন লোক আছে মসুলে। তার নাম অমুক আর সে আমার মতোই এখনো সত্যের উপর অটল আছে। তুমি তার কাছে যাও। উনি মারা গেলে পরে কবরস্থ হবার পর আমি মসুলের সেই লোকের কাছে যাই। আমি তাকে বললাম, ‘অমুক ব্যক্তি মৃত্যুর আগে আমাকে আপনার কাছে আসার উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, আপনি তার মতো একই সত্যের অনুসারী।’
তিনি বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে থেকে যাও’ আমি তার সঙ্গে থেকে গেলাম। উনিও খুব ভালো লোক ছিলেন; ঠিক তার সঙ্গীর মতো। কিন্তু উনিও বেশিদিন বাঁচলেন না। মারা যাওয়ার আগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও আমার শায়খ! অমুক ব্যক্তি আমাকে আপনার কাছে আসার ও আপনার সাহচর্যের উপদেশ দিয়েছিলেন। এখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার ডাক চলে এসেছে। আপনি আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দেন? কী করার আদেশ দেন?’ তিনি বললেন, ‘ও আমার সন্তান! এমন কারো নাম তো মনে আসছে না, যে আমার এই পথ অনুসরণ করে। তবে একজন লোক আছে নাসিবিয়ায়। তার নাম অমুক আর সে আমার মতোই এখনো সত্যের উপরে অটল আছে। তুমি তার কাছে যাও।’উনি মারা গেলে পরে কবরস্থ হবার পর আমি নাসিবিয়ার সেই লোকের কাছে যাই। আমি তাকে আমার গল্প বললাম আর জানালাম আমার সঙ্গীর কথা, যিনি আমাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন।
তিনি বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে থেকে যাও।’ আমি তার সঙ্গে রয়ে গেলাম। তিনি তার অপর দুই সঙ্গীর মতোই পরহেজগার এবং দ্বিনদার ছিলেন। আল্লাহর শপথ! খুব শীঘ্রই তাঁরও মৃত্যু হলো। মৃত্যুর আগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুকের কাছে আসার উপদেশ দিয়েছিলেন, ওই ব্যক্তি পরবর্তীতে আপনার কাছে আসার উপদেশ দেন। এখন আপনি আমাকে কোথায় যাবার উপদেশ দেন এবং কী করার আদেশ দেন?’
তিনি বললেন, ‘ও আমার সন্তান! এমন কারো নাম জানি না, যে আজকের দিনে আমাদের এই দ্বিনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত আছে; যার কাছে তুমি যেতে পারো। তবে আমুরিয়াতে একজন লোক আছে। সে আমাদের মতোই এই পথের অনুসারী। তোমার ইচ্ছে হলে তার কাছে যেতে পারো; সে সত্যপথের অনুসারী। তিনি মারা যাবার পর তাকে কবরস্থ করে আমি আমুরিয়ার সেই লোকের কাছে গেলাম, আর আমার গল্প বললাম। তিনি বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে থেকে যাও।’ আমি তার সঙ্গে রয়ে গেলাম; তিনি তার সঙ্গীদের মতোই একই পথ অনুসরণ করছিলেন।
ইতোমধ্যে আমি বেশ ধন-সম্পদ অর্জন করলাম, অনেক গরু আর মেষ ছিল আমার। তারপর এই ব্যক্তিরও শেষ সময় চলে আসল আল্লাহর নির্দেশে। মৃত্যুর আগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুকের কাছে আসার উপদেশ দিয়েছিলেন, ওই ব্যক্তি তার মৃত্যুর সময় আমাকে অমুকের কাছে পাঠান, ওই ব্যক্তি এরপর আমাকে অমুকের কাছে পাঠান তার শেষ সময়ে, এরপর উনি একইভাবে আমাকে আপনার কথা বলে যান। এখন আপনি আমাকে কোথায় যাবার উপদেশ দেন এবং কী করার আদেশ দেন?’
তিনি বললেন, ‘ও আমার সন্তান ! এমন কারো নাম আমি জানি না, যে আজকের দিনে আমাদের এই দ্বিনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত আছে; যার কাছে তুমি যেতে পারো। কিন্তু আল্লাহর একজন নবী আসার সময় হয়ে এসেছে, যিনি ইবরাহিম (আ.)-এর ধর্ম নিয়ে আসবেন। তিনি আসবেন আরব ভূমিতে আর হিজরত করবেন এমন এক জায়গায়, যার দুই ধারে আছে কালো পাথরের টিলা আর মাঝখানে খেজুর বাগান। তার কোনো লুকানো বৈশিষ্ট্য থাকবে না। উপহার হিসেবে দেওয়া খাবার তিনি খাবেন; কিন্তু সদকার খাওয়া নয়। তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে থাকবে নবুয়তের মোহর। যদি পারো ওখানে চলে যাও। এরপর উনি মারা যান এবং কবরস্থ হন। আমি আমুরিয়ায় আল্লাহর ইচ্ছাতে অনেক দিন থেকে গেলাম। এরপর একদিন কালবের কিছু ব্যবসায়ীকে ওখান দিয়ে যেতে দেখে আমি তাদের বললাম, ‘আমি তোমাদের এসব গরু ও মেষ দেবো, এর বিনিময়ে আমাকে তোমরা আরবে নিয়ে যেতে পারো? তারা তাতে সায় দিলো। আমিও তাদের সব গরু আর মেষ দিয়ে দিলাম। তারা আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো। কিন্তু আল ওয়াদি আল কুরার কাছে আসার পর তারা আমাকে প্রতারিত করল এবং অন্য ইহুদির কাছে আমাকে ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দিলো। তার সঙ্গে থাকার সময় ওই খেজুর বাগান আমার চোখে পড়ে। আমার মন বলছিল, এটাই আমার আমুরিয়ার সেই শায়খের বর্ণিত জায়গা; তবে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।
একদিন আমার মনিবের এক জ্ঞাতি ভাই এলো মদীনার বনু কুরায়জা গোত্র থেকে। আমার মনিব আমাকে এবার তার কাছে বেচে দিল আর সে আমাকে মদীনাতে নিয়ে এলো। আল্লাহর শপথ! আমি দেখামাত্রই জায়গাটা চিনতে পারলাম, ঠিক যেমনটা আমার সঙ্গী বলেছিলেন। আমি সেখানে থাকতে লাগলাম। এদিকে আল্লাহ তার রাসুল (স.)-কে পাঠালেন মক্কাতে। ক্রীতদাসের কাজের ভারে আমি এই সময়টা তার ব্যাপারে কিছুই শুনিনি। তারপর তিনি মদীনাতে এলেন। আল্লাহর শপথ! একদিন আমি ছিলাম আমার মনিবের এক খেজুর গাছের উপরে। আমি কিছু কাজ করছিলাম আর আমার মনিব কাছেই বসে ছিলেন। এমন সময় তার এক জ্ঞাতি ভাই এসে তাকে বলা শুরু করলো—
‘বানু কায়লাকে আল্লাহ ধ্বংস করুন। আল্লাহর শপথ! এই মুহূর্তে তারা কুবাতে সমাবেশ করছে এক লোককে স্বাগত জানাতে; যে আসছে মক্কা থেকে। তারা বলছে, সে একজন নবী।’
এ কথা শুনে আমার এমন কাঁপুনি ছুটল যে, মনে হলো আমি আমার মনিবের উপরেই পড়ব। গাছ থেকে নেমে এসে আমি ওই লোককে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, ‘বলছ কি তুমি? বলছ কি তুমি?’ আমার মনিব এসব দেখে বেশ রেগে গেলেন আর আমাকে একটা ঘুষি মেরে বললেন, ‘এসব দিয়ে তোমার কী কাজ? কাজে মনোযোগ দাও।’
আমি বললাম, ‘কিছু না। আমি কেবল ঠিকভাবে জানতে চাচ্ছিলাম উনি কী বলছেন।’ আমার কিছু সংগ্রহ ছিল। সন্ধ্যা হলে আমি ওগুলো নিয়ে রাসুল (স.) এর কাছে গেলাম। তখনো তিনি কুবাতে ছিলেন। আমি তার কাছে গেলাম আর বললাম, ‘আমি শুনেছি আপনি একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ আর আপনার সঙ্গীরা খুব নি:স্ব; তাদের সাহায্যের দরকার। এই জিনিসগুলো তাই আমি সদকার নিয়তে নিয়ে এসেছি। আমার মনে হচ্ছে, অন্য যে কারো চেয়ে আপনারই এসবের বেশি প্রয়োজন। আমি ওগুলো রাসুল (স:)-এর কাছে নিয়ে গেলে তিনি সাহাবীদের (রা.) ওটা খেতে বললেন; কিন্তু নিজে বিরত থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, “এই তো প্রথম আলামত নবুয়তের।’ আমি চলে গিয়ে আরো বেশ কিছু জিনিস জোগাড় করলাম। এরমধ্যে রাসুল (স.) মদীনাতে চলে এসেছেন।
আমি তখন তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি তো সদকার খাবার খান না। তাই আমি আজ কিছু উপহার নিয়ে এসেছি আপনার সম্মানে।’ রাসুল (স.) তা থেকে নিজে কিছু খেলেন আর সাহাবীদেরও (রা.) শরিক হতে বললেন। আমি দ্বিতীয় আলামতও পেয়ে গেলাম।
এরপর আমাদের দেখা হয় বাকি আল গারকাদে, ওখানে রাসুল (স.) তার একজন সাহাবীর (রা.) জানাযা পড়াচ্ছিলেন। তাঁর গায়ে দুটো শাল ছিল আর উনি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে বসে ছিলেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। এরপর তাঁর পেছনে এসে তার কাঁধের নবুয়তের মোহর দেখার চেষ্টা করলাম; যার বর্ণনা আমি শুনেছিলাম আমুরিয়ার সেই শায়খের কাছে। যখন রাসুল (স.) আমাকে তাঁর পেছনে যেতে দেখলেন, তখন তিনি বুঝলেন আমি এমন কিছু খুঁজছি, যার বর্ণনা আমাকে দেওয়া হয়েছে। তিনি তার পেছনের কাপড়টা সরিয়ে দিলেন। আমি নবুয়তের মোহর দেখে নিশ্চিত হলাম। এরপর আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম, মোহরের জায়গাটিতে চুমু খেলাম আর ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। রাসুল (স.) আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন। আমি তাই করলাম আর আমার গল্প বললাম ঠিক যেমন করে এখন তোমায় বলছি ও ইবনে আব্বাস (রা.)!
রাসুল (স.) চাইলেন তার সাহাবীরাও এই কাহিনী শুনুক। এরপর আমি আমার কৃতদাসের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, বদর আর উহুদ চলে গেল, আমি রাসুল (স.)-এর সঙ্গে থাকতে পারলাম না। রাসুল (স.) একদিন বললেন, ‘ও সালমান, তোমার মনিবের সঙ্গে তুমি একটা মুক্তির বন্দোবস্ত করো।’
আমি আমার মনিবের সঙ্গে চুক্তি করলাম যে, আমি তার জন্য ৩০০টা খেজুর চারা লাগিয়ে দেব, আর ৪০ উকিয়া দেব। এর বিনিময়ে সে আমাকে মুক্তি দেবে। আল্লাহর রাসুল (স.) তার সাহাবীদেরকে (রা.) বললেন, ‘তোমাদের ভাইকে সাহায্য করো’। তারা আমাকে খেজুরের চারা দিয়ে সাহায্য করলো। একজন ৩০টা, একজন ২০টা, একজন ১৫টা, একজন ১০টা—এভাবে সবাই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দিলো, যতক্ষণ না ৩০০টা খেজুর চারা পূর্ণ হলো।
রাসুল (স.) বললেন, ‘ও সালমান, যাও! গিয়ে গর্ত খোঁড়া শুরু করো, যেখানে চারাগুলো লাগাবে। কাজ শেষ হলে আমাকে জানাও। আমি নিজ হাতে ওগুলো লাগাবো।’ তারপর আমি গর্ত খোঁড়া শুরু করলাম আর আমার সঙ্গীরা আমাকে সাহায্য করল। যখন আমার কাজ শেষ হলো, তখন আমি রাসুল (স.)-কে জানালাম।
আল্লাহর রাসুল (স.) আমার সঙ্গে বেরিয়ে এলেন, আমরা চারাগুলো এগিয়ে দিচ্ছিলাম আর উনি ওগুলো গর্তে রোপন করছিলেন। শপথ সেই পবিত্র সত্ত্বার, যার হাতে এই সালমানের প্রাণ, একটা চারাও মরেনি। চুক্তি অনুযায়ী, খেজুর চারা রোপন করা হয়ে গেলেও আমার টাকার অংশটা তখনো বাকি। একবার এক যুদ্ধজয় থেকে ডিমের আকারের মতো এক টুকরো সোনা আল্লাহর রাসুল (স.)-এর কাছে এলো। উনি আমায় খুঁজছিলেন, ‘ওই পার্সিয়ান কোথায়, যার মনিবের সঙ্গে তার মুক্তিপনের বন্দোবস্ত ছিল?’
আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হলে তিনি বললেন, ‘ও সালমান! যাও, এটা দিয়ে তোমার ঋণ শোধ করো।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল (স.)! এটুকু দিয়ে কী করে আমার সব ঋণ শোধ হবে?’ তিনি বললেন, ‘এটা নাও। আল্লাহই তোমাকে তোমার ঋণশোধের ব্যাপারে সাহায্য করবেন।’ আমি ওটা নিয়ে গিয়ে ওজন দিলাম; শপথ সেই পবিত্র সত্ত্বার যার হাতে এই সালমানের প্রাণ, দেখি ওটার ওজন ঠিক ৪০ উকিয়া। আমি তখন চুক্তি অনুযায়ী সব দেনা শোধ করলাম আর আমার মনিব আমায় মুক্ত করে দিলো। খন্দকের যুদ্ধে আমি রাসুল (স.)-এর সঙ্গে ছিলাম এবং এরপর আর কোনো বড় ঘটনাতে আমি তার সঙ্গ ছাড়িনি।
এই ঘটনাটি ইমাম আহমাদ (রহ) তার মুসনাদ (৫/৪৪১)-এ বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসরা এই হাদিসটিকে হাসান সাব্যস্ত করেছেন।
সালমান ফারসি (র.) দীর্ঘ হায়াত লাভ করেছিলেন। ২৫০ মতান্তরে ৩৫০ বছর, আর কারো মতে, তিনি ঈসা (আ.)-এর যুগও পেয়েছেন। তবে ২৫০ বছরের অভিমতটিই বিশুদ্ধ। উসমান (রা.)-এর খিলাফতাকালে ৩৫ হিজরি সনে মাদাইনে তিনি ইন্তেকাল করেন। (মেশকাত (আসমাউর রিজাল), পৃষ্ঠা-৫৯৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজরত সালম ফারসির জীবন থেকে ইসলামের প্রতি আবেগ-ভালোবাসা ও ত্যাগের দীক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

