পবিত্র রমজানের শ্রেষ্ঠ রাত লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। এই রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কদরের রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসূল প্রেরণকারী। তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা দুখান: ২-৬)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, নিশ্চয়ই আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমরা কি জানো ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত। (সুরা কদর: ১-৫)
বিজ্ঞাপন
আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ এর ফারসি ‘শবে কদর’। লাইলাতুন বা শব-এর অর্থ রাত। কদর অর্থ পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ, ভাগ্য নিরূপণ, সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।
এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন) রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫)
আরও পড়ুন: কদরের রাতে যে আমলগুলো ভুলেও ছাড়বেন না
রমজানের কোন রাতটি ‘লাইলাতুল কদর’ তা সুনির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়নি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (স.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকেরই একটি রাত। যে কারণে তিনি রমজানের শেষ দশকটি ইতেকাফে কাটাতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকে অনুসন্ধান করো। (সহিহ বুখারি: ২০২০, সহিহ মুসলিম: ১১৬৯)
বিজ্ঞাপন
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন: আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, তারপর আমার পরিবারের একজন আমাকে জাগিয়ে দিলেন, ফলে আমি তা ভুলে গেলাম। আপনারা লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ রাতে অনুসন্ধান করুন। (সহিহ মুসলিম: ১১৬৬)
হাদিস অনুযায়ী, রমজানের শেষ দশকে শবে কদর রয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাতে শবে কদরের সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা মহানবী (স.) আরেক হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০১৭)
অর্থাৎ রমজানের শেষ দশকের যে কোনো একটি রাত তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রমজানের রাতগুলোর কোনো একটি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আরও পড়ুন: শবে কদরে যেভাবে ইবাদত করবেন
কিছু হাদিসে এ রাতের কিছু আলামত বা চিহ্ন বলে দেওয়া হয়েছে যা দেখে বোঝা যেতে পারে ওই রাতই লাইলাতুল কদর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদরের রাতটি হবে প্রফুল্লময়। না গরম, না ঠাণ্ডা। সেদিন সূর্য উঠবে লালবর্ণে, তবে দুর্বল থাকবে।’ (ইবনু খুজাইমাহ: ২১৯২)
অন্য হাদিসে নবীজি (স.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের আলামত হচ্ছে- স্বচ্ছ রাত, যে রাতে চাঁদ উজ্জ্বল হবে, আবহাওয়ায় প্রশান্তি (সাকিনাহ) থাকবে। না ঠাণ্ডা, না গরম। সকাল পর্যন্ত (আকাশে) কোনো উল্কাপিণ্ড দেখা যাবে না। সে রাতের চাঁদের মতোই সূর্য উঠবে (তীব্র) আলোকরশ্মি ছাড়া। শয়তান সেই সময় বের হয় না।’ (মুসনাদ আহমদ: ২২৭৬৫)
এ সম্পর্কে নবী (স.) আরও বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর রয়েছে সপ্তম, নবম অথবা বিংশ, যে রাতে (পৃথিবীর) নুড়ি পাথরের চেয়ে বেশি সংখ্যক ফেরেশতা জমিনে নেমে আসে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৩/১৭৮; সহিহ আল-জামে: ৫৪৭৩)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুলের (স.) সামনে কদরের রাত সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে ওই রাত মনে রাখবে, যখন চাঁদ উদিত হবে থালার একটি টুকরোর মতো বা অর্ধেক থালার মতো। (সহিহ মুসলিম: ২৬৬৯)
আরও পড়ুন: শবে কদরে ৬টি দোয়া করতে ভুলবেন না
অনেক আলেম মনে করেন, এ হাদিসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, লাইলাতুল কদর মাসের শেষ ভাগে হয়ে থাকে, কারণ চাঁদ থালার মতো উদিত হয় সাধারণত মাসের শেষের দিকে।
লাইলাতুল কদরের আলমত প্রকাশ পায় পরবর্তী দিনেও। উবাই ইবনে কা’ব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেছেন, লাইলাতুল কদরের আলামত হলো- ওই রাতের পর দিনের সূর্য উদিত হয় সাদা আভাযুক্ত উজ্জল হয়ে তাতে তীব্র রশ্মি থাকে না। (সহিহ মুসলিম: ১৬৫৮)
একইরকম আরেকটি হাদিস: আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (স.) বলেছেন, ‘ওই রাতের আলামত বা লক্ষণ হলো- রাত শেষে সকালে সূর্য উদিত হবে তা উজ্জ্বল হবে। তবে উদয়ের সময় তার কোনো তীব্র আলোকরশ্মি থাকবে না (অর্থাৎ দিনের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ হবে)। (মুসলিম: ১৬৭০; ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ১৬৫৫)