আবু মাহজুরা আল-জুমাহি (রা.)। প্রিয়নবীজির মনোনীত একজন মুয়াজ্জিন। এই সাহাবির ইসলামগ্রহণের ঘটনা শুনলে অবাক হতে হয়। আজানকে ব্যঙ্গ করার মাধ্যমেই তিনি অজান্তে ইসলামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে নবীজির হাতে ইসলামগ্রহণ করেন। পরে মক্কার মসজিদে হারামের মুয়াজ্জিন নির্বাচিত হন। সুমধুর ও সুউচ্চ কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
হুনাইন যুদ্ধের পরের ঘটনা। রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবিদের নিয়ে যুদ্ধ থেকে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে জিইরানা নামক জায়গায় নামাজের সময় হলে আজান দেওয়া হলো। পাশেই অবস্থান করছিলো মুশরিক তরুণদের একটি দল। যারা মুসলমানদের বিব্রত করার জন্যই বের হয়েছিল। আজানের শব্দ শুনে তারা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে আজানকে পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। তাদের মধ্যে একজনের কণ্ঠ ছিল অসাধারণ। তার সূর নবীজির কান পর্যন্ত পৌঁছেছিল। নবীজি তাদের ডেকে পাঠালেন। তারা সামনে এলে নবীজি জিজ্ঞেস করলেন- তোমাদের মধ্যে কে এইমাত্র আজান দিল?
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যে সাহাবির সঙ্গে কথা বলেছেন মহান আল্লাহ
তখন তারা খুব লজ্জাবোধ করে একে অপরের দিকে তাকালো। কারণ তারা তো ঠাট্টার স্বরে আজান দিয়েছিল। রাসুলুল্লাহ তখন একজন একজন করে আজান শুনতে লাগলেন এবং সর্বশেষ আবু মাহজুরা আজান দিলে তার আজান নবীজির মনপুত হলো। তখন তিনি তাঁর বরকতময় হাত দ্বারা আবু মাহজুরার পাগরি খুলে তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক ফিহি, ওয়াহদিহি ইলাল ইসলাম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তাকে বরকত দাও এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দাও।’
আবু মাহজুরার ভাগ্য খুলে গেল, নবীজির বকতময় হাতের স্পর্শ পেয়ে বলে উঠলো- আশহাদু আললা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্নাকা রাসুলুল্লাহ। অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতিত সত্য মাবুদ নেই, আর নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল।
ঘটনা বর্ণনায় আবু মাহজুরা (রা.) বলেন, তিনি (রাসুল স.) একেক করে আমাদের সবার থেকে আজান শুনলেন। আমার থেকে শুনলেন সবার শেষে। আমার কণ্ঠটাই তাঁর কাছে ভালো লাগল। তাই তিনি আমাকে সামনে বসালেন। আমার মাথার অগ্রভাগে হাত বোলাতে বোলাতে তিনবার আমার জন্য বরকতের দোয়া করলেন। এরপর আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এতক্ষণে তাঁর প্রতি আমার অন্তরের বিদ্বেষ দূর হয়ে গেল। আমি সাদরে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম কবুল করলাম। অতঃপর তিনি আমাকে বলেন, যাও! মসজিদের হারামে গিয়ে আজান দাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কীভাবে আজান দেব? তিনি আমাকে আজানের তালিম দিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/১১৭—১১৮)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যে সাহাবির নাম পবিত্র কোরআনে এসেছে
সম্মানিত এই সাহাবির চুল নারীদের মতো লম্বা ছিল। কারণ ইসলাম গ্রহণের সময় রাসুল (স.) তাঁর মাথার অগ্রভাগের চুলগুলোর ওপর হাত বুলিয়েছিলেন। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত সে চুলগুলোকে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন। যে চুলে প্রিয়নবীর হাত লেগেছে, তা কেটে ফেলতে তাঁর মন সায় দেয়নি। ফলে তার চুল ছিল নারীদের চুলের মতো লম্বা। ইবনে মুহাইরিজ (রহ.) বলেন, আমি হজরত আবু মাহজুরা (রা.)-এর লম্বা চুল দেখে তাঁকে বললাম, আপনি কি আপনার চুলগুলো কাটবেন না? তিনি জবাব দিলেন, যে চুলে রাসুল (স.) হাত বুলিয়েছেন এবং বরকতের দোয়া করেছেন, সেটা আমি কোনো অবস্থাতেই কাটতে পারি না। এটা ছিল তাঁর নবীপ্রীতির এক অকৃত্রিম জজবা। (তাহজিবুল কামাল: ১০/১৯৭)
নবীপ্রেমী এই মুয়াজ্জিন সাহাবি আমরণ মসজিদে হারামে আজানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/১১৭, ১১৮; আত-তাবাকাতুল কুবরা: ৬/৭-৮)
আবু মাহজুরা (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর মক্কাতেই বসবাস করেন এবং ৫৯ হিজরিতে তিনি মক্কায় ইন্তেকাল করেন।