মেরাজ নবীজির জীবনের অলৌকিক এক ঘটনা। মেরাজের যাত্রা শুরু হয় মসজিদে হারাম থেকে। মহানবী (স.) বোরাক নামক বাহনে চড়ে নিমিষেই মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা যান। এই সফরের নাম কোরআনের ভাষায় ‘ইসরা’। অতঃপর ওখানে নামাজ আদায়ের পর বিশেষ সিঁড়িতে চড়ে প্রথম আসমানে, এরপর ধারাবাহিকভাবে সপ্তম আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা এবং সেখান থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সাক্ষাৎ লাভ করেন। মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বগমের এই সফরকে বলা হয় মেরাজ। এই সফরে নবীজি জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ৫ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। রাতেই এসব ঘটনা ঘটেছে।
রাতে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটি সকালে নবীজি (স.) বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কাফেররা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অধিকাংশ লোক বলে উঠল, আল্লাহর কসম, এ তো এক আজব ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার! একটি কাফেলার শামে (সিরিয়া) যেতে একমাস ও আসতে একমাস লাগে। আর মুহাম্মদ কিনা এই রাতের মধ্যে সেখানে গিয়ে আবার ফিরে আসলেন!
বিজ্ঞাপন
এরপর শুরু হয় কাফেরদের বিদ্রূপ। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নবীজিও জবাব দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে কাফেরা হতভম্ব হয়ে যায়। তাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। এরপর সমগ্র বিশ্ববাসী মেরাজের সত্যতা মেনে নেয়। কী ছিল নবীজির সেই ৩ জবাব। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আরও পড়ুন: শবে মেরাজের ঘটনা কোন সুরায় আছে, হাদিসে কী আছে
১. বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া
শবে মিরাজের পরদিন সকাল বেলা। নবীজি হাতিমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাতে সংঘটিত মেরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক ঠাওরাবে নাতো? ইতিমধ্যে কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জেহেল। নবীজির কাছে বসে বিদ্রূপের ছলে বলল, কোনো ব্যাপার আছে না কি? নবীজি বললেন, হ্যাঁ। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মেরাজ হয়েছে । সে বিস্ময়ের সাথে সুধাল, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল? নবীজি বললেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত। সে আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে? তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, হ্যাঁ। এরপর আবু জেহেল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজি আরও সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই। আবু জেহেল লুয়াই ইবনে কা’ব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সকলে এসে উপস্থিত হলে আবু জেহেল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে, পারলে তা এদের কাছেও ব্যক্ত করো। নবীজি পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিল। তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।
নবীজি বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম। আমি তখনও কাবার হাতিমে পুরো কওমের সামনে দণ্ডায়মান, ইতিমধ্যেই পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হলো। আকিলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মাকদিস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিসংকোচে বলতে লাগলাম। শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নবীজি (স.)-এর সামনে কুদরতিভাবে বায়তুল মুকাদ্দাসকে তুলে ধরেছিলেন, আর তিনি দেখে দেখে তাদের প্রশ্নের জবাব দিলেন। এ বিষয়ে নবীজি (স.) বলেন- فَجَلَّى اللهُ لِى بَيْتَ الْمَقْدسِ فَطَفِقْتُ اُخْبِرهُمْ عَنْ ايَاتِه وَ اَنَا اَنْظُرُ- مسلم ‘অতঃপর আল্লাহ পাক বায়তুল মুকাদ্দাসকে আমার চোখের সামনে তুলে ধরলেন, আর তারা যা জিজ্ঞাসা করছিল, আমি দেখে দেখে গণনা করে করে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনের আল আকসা মসজিদের আদ্যোপান্ত
২. যাওয়ার পথে ব্যবসায়ী কাফেলাকে উটের সন্ধান দেওয়ার ঘটনা
মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে যথাযথ জবাব দেয়ার পরও কাফেরদের সন্দেহ দূরীভূত হয়নি। তারা বলল, আপনার এই ভ্রমণের কোনো সাক্ষী আছে কি? নবীজি বললেন, হ্যাঁ, সাক্ষী আছে। আমি যখন বায়তুল মুকাদ্দাস যাচ্ছিলাম, তখন ‘রওহা’ নামক স্থানে তোমাদের এক ব্যবসায়ী কাফেলা দেখতে পেয়েছি। তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তাদের সালাম দিয়েছি এবং উটের সন্ধান বলে দিয়েছি।
৩. ফেরার পথে আরেকটি কাফেলার পানি পানের ঘটনা
নবীজি কাফেরদের বলেন, প্রত্যাবর্তনের সময় আরেকটি কাফেলা দেখেছি, তাদের পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা ছিল। আমি ঢাকনা খুলে পানিটুকু পান করে ফেলেছি। এই কাফেলাটি অগ্রসর হচ্ছে তানয়িম অভিমুখে। তাদের সম্মুখে আছে একটি খাঁকি রঙের উট, তার পিঠে রয়েছে কালো রঙের চট এবং দুটি কালো বস্তা।
আরও পড়ুন: নবীদের মধ্যে মহানবী (স.)-এর বিশেষত্ব
তানয়িম মক্কা থেকে বেশি দূরে নয়। তাই তারা মহানবীর কথা সত্য কি না যাচাই করার জন্য সেদিকে ছুটে গেল। যথাস্থানে পৌঁছে কাফেলাকে পেয়ে গেল। নবীজির বর্ণনা মতো সেই উটটিকেও দেখতে পেল। তাদেরকে পানির কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তারা জানাল, পাত্রখানি ঠিকমতো ঢাকাই ছিল। কিন্তু কেন জানি পানি পাওয়া গেল না। এদিকে প্রথম কাফেলাটি মক্কায় পৌঁছে গেছে। তাদেরকে উট হারানোর কথা জিজ্ঞেস করা হলে তারা স্বীকার করে বলল, এক অজ্ঞাতজনের ডাক তারা শুনেছে এবং সে আওয়াজ অনুসরণ করে তাদের হারানো উট ফিরে পেয়েছে।
এভাবেই মেরাজ তথা মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্বগমনের সত্যতা স্পষ্ট হয় সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে। (মাহবুবে খোদা; সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া; তিরমিজি: ৩৪৬২; মুসতাদরাক: ২/৩৬১)

