ওয়াজ-মাহফিলে ইদানীং ব্যক্তির নাম ধরে গিবত করার চর্চা বেড়ে গেছে। চিন্তাও করা হয় না- শ্রোতাদের নসিহত করতে হবে কী, আর করছেটা কী! ওয়াজ-নসিহত হতে হবে হজরত লোকমান (আ.)-এর উপদেশবাণীর মতো। যা আল্লাহ তাআলার পছন্দ হওয়ায় তিনি পবিত্র কোরআনে তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলল, হে পুত্র আমার, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহা অপরাধ।’ (সুরা লোকমান: ১৩)
পরের আয়াতে মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, এরপর নামাজ কায়েম, অতঃপর বিনয়, নম্রতা ও সবরের উপদেশ, এছাড়া সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, অহংকার পরিত্যাগ, কণ্ঠকে নিচু করা, পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়য়ের উল্লেখ রয়েছে। (দেখুন: সুরা লোকমান: ১৪-১৯)
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও হারাম উপার্জন, সুদ, ঘুষ, অশ্লীলতা, মানুষের অধিকার নষ্ট করা ইত্যাদি বিষয়গুলোর গুরুত্ব কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। ঈমান শিক্ষা, কোরআন শিক্ষা, জাকাত-কোরবানির শিক্ষা, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব, বিদআতের পরিণতি, নতুন নতুন ফেতনায় করণীয় কী, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, ইবাদতে একনিষ্ঠতা, আল্লাহর ভয়, পরোপকার, আত্মীয়তা রক্ষা, সচ্চরিত্র, সরল জীবন-যাপন, বিপদে ধৈর্যধারণ ও সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর শুকরিয়ার গুরুত্ব—এসব বিষয়গুলো ইসলামি অঙ্গনে ঢুকলেই দৃশ্যমান হয়। এসব নিয়ে ওয়ায়েজদের কথা না বলার কথা নয়। আর এসব কথাগুলোই আসলে উপকারী। আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘আপনি উপদেশ দিন। কেননা, উপদেশ বিশ্বাসীদের উপকারে আসে।’ (সুরা জারিয়াত: ৫৫)
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- এসব বিষয়ে আলোচনা হয় খুবই কম, মানুষের গিবত হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গল্পের আকারে, মজা করে করেই এসব হয়। কেউ কেউ তো মাইক হাতে নিয়েই উচ্চারণ করেন, অমুক শয়তান, তমুক কাফের ইত্যাদি নিকৃষ্ট শব্দ। অথচ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা হলো- কারো মধ্যে সুস্পষ্ট কুফর পাওয়া না গেলে কাফের বলা যাবে না।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি (অন্যায়ভাবে) তার মুসলমান ভাইকে ‘কাফের’ বলে, নিঃসন্দেহে তাদের যেকোনো একজনের প্রতি কুফরি আপতিত হবে। তার কথায় বাস্তবতা না থাকলে কুফরি তার নিজের দিকেই বর্তাবে।’ (বুখারি: ২/৯০১, মুসলিম: ১১১)
বিজ্ঞাপন
এই হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কোনো মুসলমানকে ‘কাফের’ বলা হারাম। এমনকি অজ্ঞতাবশত কেউ শরিয়তের কোনো বিধান অস্বীকার বা বিরোধিতা করলেও তার বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। (মুখতাসারু ফতোয়া মিসরিয়া: ৫৭২; আল আওয়াসেম: ৪/১৭৪)
ওয়ায়েজদের চিন্তা করা উচিত- ওয়াজ মাহফিল অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা ও হাসি-তামাশা করারও জায়গা নয়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যক্তির (জীবনে) ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা।’ (তিরমিজি: ২৩১৭)
এছাড়াও ওয়াজ হতে হবে বানোয়াট কিসসা-কাহিনী থেকে মুক্ত। কোরআন, তাফসির, গ্রহণযোগ্য হাদিস এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের বাণী এবং সত্য ও শিক্ষণীয় ঘটনাবলির আলোকেই ওয়াজ করা অপরিহার্য। যাচাই করা ছাড়া যেকোনো বই থেকে কোনো কথা বা ঘটনা পেয়েই বয়ান করা যাবে না। আর জাল হাদিস বর্ণনা করা কবিরা গুনাহ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জেনে-শুনে আমার নামে কোনো মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে, সে মিথ্যাবাদীদের একজন।’ (তিরমিজি: ২৬৬২) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমি বলিনি এমন কথা আমার পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত বর্ণনা করে, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি: ১০৭)
ওয়াজ-মাহফিলে অযথা আলাপ বন্ধ করতে প্রধান করণীয় হলো- বক্তা নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে। ইসলামের সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন আল্লাহভীরু আলেম নির্বাচন করতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ইসলাহ তথা সমাজ সংশোধনের কাজ সোপর্দ করা রাসুল (স.)-এর বাণী অনুসারে কেয়ামতের নিদর্শন। ইসলামী আইন বিষয়ক বিশ্বকোষ ‘আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ওয়ায়েজ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে। ১. ওয়ায়েজ ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক ও বিবেকবান হতে হবে। ২. ন্যায়পরায়ণ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। ৩. হাদিসের শব্দ, অর্থ, ব্যাখ্যা, বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। ৪. কোরআনের তাফসির করার যোগ্যতা থাকতে হবে। কোরআনের কঠিন থেকে কঠিন বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে। পূর্বসূরি মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা জানা থাকতে হবে।’ (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যা: ৪৪/৮১)
‘এলাকার লোক’, ‘সুললিত কণ্ঠের অধিকারী’, ‘মজার ওয়ায়েজ’ ইত্যাদি বক্তা নির্বাচনের শরিয়তের মানদণ্ড নয়। তবে হ্যাঁ, পরহেজগার ও হক্কানি আলেম হওয়ার পাশাপাশি এসব গুণ কারও মধ্যে থাকলে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে কোনো অসুবিধা নেই। (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা: ৪৪/৮১; ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ২/৩৬৭)

