সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দেড়শ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে দারুল উলুম দেওবন্দ

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

দেড়শ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে দারুল উলুম দেওবন্দ

এশিয়ার বৃহত্তম বেসরকারি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দ। ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষের মানুষের মাঝে ইসলাম ও দেশপ্রেমের চেতনা বিস্তারের লক্ষ্যে মওলানা কাসিম নানুতাবির (১৮৩২-৮০ খ্রি.) নেতৃত্বে দেওবন্দের সাত্তা মসজিদে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হয়।

ভারতের সুপরিচিত ইসলামি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওয়াসি বলেন, ১৫০ বছর আগে ভারতে মুসলিম শাসনের অবসানের পরই কিন্তু দেওবন্দ স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। ভারতীয় মুসলিমরা তখন ভাবলেন ক্ষমতা হাতছাড়া হলেও নিজেদের ধর্মীয় পরম্পরা তো রক্ষা করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই ১৮৬৬ সালের ৩০ মে দেওবন্দের ছত্তেওয়ালি মসজিদে মাত্র একজন ওস্তাদ ও একজন সাগরেদকে নিয়ে এই মাদ্রাসার জন্ম। ঘটনাচক্রে যাদের দুজনের নামই ছিল মাহমুদ!’


বিজ্ঞাপন


শিক্ষক ছিলেন মোল্লা মাহমুদ দেওবন্দী। আর ছাত্র ছিলেন মাহমুদ আল হাসান- যিনি পরবর্তীকালে শায়খ আল-হিন্দ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ব্রিটিশবিরোধী রেশমি রুমাল আন্দোলনের নায়ক ছিলেন তিনি। 

সেদিনের সেই ছোট্ট মাদ্রাসাই আজ মহীরুহের মতো এক বিশাল প্রতিষ্ঠান যার স্বীকৃতি ও সম্মান গোটা ইসলামি বিশ্বজুড়ে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসলামি বিশ্বে কায়রো বা মদিনার মতো বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র অনেক আছে। দেওবন্দের পরিসর হয়তো বিশাল না-হতে পারে, কিন্তু এটা হলো পাউরুটির ওপর মাখনের মতো। মানে এখানে যে ইসলামি জ্ঞান, শিক্ষার গভীরতা বা আধ্যাত্মিকতার পাঠ আপনি পাবেন তার তুলনা কোথাও মিলবে না!’

বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা আহরণ করতে শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নিচ্ছে। কত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের এখানেই হাতেখড়ি হয়েছে তার হিসেব নেই। উপমহাদেশের অধিকাংশ আলেম এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রয়াত আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফী, প্রয়াত মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, প্রয়াত আমীর আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী এবং প্রখ্যাত ইসলামিক পন্ডিত শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ)-এর মতো পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা ভাসানী এই প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র ছিলেন। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, দ. আফ্রিকা ও সৌদি আরবের অনেক বিখ্যাত মনীষী এই প্রতিষ্ঠানেরই প্রাক্তন ছাত্র।

আরও পড়ুন: ৩০০ বছর দাঁড়িয়ে আছে মোঘল আমলের উলচাপাড়া শাহী মসজিদ


বিজ্ঞাপন


দারুল উলুম দেওবন্দ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে আটটি মূলনীতি গ্রহণ করা হয়, তার উদ্দেশ্য মাদ্রাসাটিকে সরকার ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। নিয়ম অনুযায়ী আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনের পর এতে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত আরও আট বছর আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, দর্শন, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, হাদিস, উসুলে তাফসির, ফরায়েজ, আকাইদ, কালাম, মুনাজারা, কিরাত, তাজবিদ এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়া হয়। দাওরায়ে হাদিসের পর এক বছর মেয়াদি তাকমিলে তাফসির, তাকমিলে মাকুলাত, তাকমিলে দ্বীনিয়াত ও দাওয়াহ প্রশিক্ষণ এবং দুবছরের তাকমিলে সাদার ও চার বছরের জন্য ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাঠ্যক্রম নির্দিষ্ট আছে।

জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দেওবন্দ মাদ্রাসা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো সাহায্য নেয়নি। দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতাদের বিধান ছিল সেরকমই। ফলে আজও এই প্রতিষ্ঠান চলে পুরোপুরি সাধারণ মানুষের দানে আর তাদেরই সাহায্যের ভরসায়। বলা হয়ে থাকে, যে পরিবার দেওবন্দকে সামান্য এক মুঠো চালও দিয়েছে, তাদের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক রয়ে যায় বংশপরম্পরায়, নাড়ির টান থেকে যায় আজীবন।

দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী অনেক মাদ্রাসা রয়েছে ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার নানা দেশে। যেগুলোকে কওমি মাদ্রাসা হিসাবে সবাই চিনে থাকেন। শুধু বাংলাদেশেই রয়েছে ২০ হাজারের অধিক। ২০২২ সালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা (বোর্ডোর অধীন) ১৯ হাজার ১৯৯টি।

আরও পড়ুন: সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে কতটা লাভবান কওমি শিক্ষার্থীরা?

বর্তমান বিশ্বের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন ও জাস্টিস আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানী দারুল উলুম দেওবন্দ সম্পর্কে বলেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দ প্রান্তিক কোনো দলের নাম নয়, না এটি কোনো রাজনৈতিক পার্টি, না এটি এমন কোনো গোষ্ঠীর নাম যা সত্য ও অসত্য সবক্ষেত্রে অন্যের সঙ্গে আপোষ করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর না এটি তর্কবিতর্ক করার এমন কোনো টিম যা বিশেষ কোনো দল ও মতের খণ্ডনের জন্যে অস্তিত্বে এসেছে- বরং প্রকৃত অর্থে দারুল উলুম দেওবন্দ হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহর ওই বাস্তব ব্যাখ্যার নাম; যা সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়িন ও পূর্বসূরি মনীষীদের মধ্যস্থতায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। এটা ওই কীর্তি ও অঙ্গীকারের নাম; যার সূত্রধারা বদর ও উহুদের ময়দান পর্যন্ত নিয়ে পৌঁছায়। এটা ওই ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত, তাকওয়া ও তাহারাত, বিনয় ও সরলতা, সত্যকথন ও নির্ভয়তার নাম; যা ইসলামি ইতিহাসের সকল ধাপে উলামায়ে হকের বৈশিষ্ট্য ছিল।’ (জাহানে দিদাহ; তাকি উসমানি, পৃ. ৫১১, মাকতাবায়ে মাআরেফুল কোরআন, করাচি, নতুন সংস্করণ ১৪৩১ হি./২০১০ ঈ.)

দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া, নামাজ ও খেলাধুলাসহ সবকিছুর নিয়মকানুন রয়েছে। প্রতিদিন দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থীদের সকাল-বিকাল-রাত তিন সময়ে ক্লাস করতে হয়। অন্যান্যদের জন্য সকাল ও বিকালে ক্লাস করার পর মাগরিব ও এশার পর তাকরার এবং মোতালায়ার সময়। এমদাদি (সম্পূর্ণ ফ্রি) ছাত্রদের দৈনিক দু’বেলা খাবার দেওয়া হয়। দুপুরে দেওয়া হয় গমের রুটি আর ঘন ডাল, বিকেলে রুটি আর মহিষের গোশত। যারা ফ্রিতে খায়, তাদের সিলভারের দুটো টিকিট দেওয়া হয়। টিকিট আর একটা বাটি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হয়।

ক্লাসরুম আর বেডরুম ভিন্ন। মাদরাসার বিস্তীর্ণ জমিতে থাকার জন্য তিনতলা করে সুবিশাল অনেক হোস্টেল রয়েছে। নাম দারে জাদিদ, শাইখুল হিন্দ মঞ্জিল, আফ্রিকি মঞ্জিল, দারুল কোরআন, বাবুজ জাহির ইত্যাদি। দারে জাদিদে ছাত্রদের শোবার জন্য রয়েছে খাটের সুব্যবস্থা। অন্য মঞ্জিলে ফ্লোরেই বিছানা পাততে হয়। তবে প্রতিটি মঞ্জিলেই প্রত্যেক ছাত্রের জন্য রয়েছে বড় বড় আলমিরা।

আরও পড়ুন: সাদ ইস্যুতে আরশাদ মাদানির বক্তব্যের পর দেওবন্দের প্রতিক্রিয়া

দুপুরে ক্লাসের পর থেকে জোহর পর্যন্ত ছাত্রদের আরামের সময়। জোহরের নামাজ একটু দেরিতেই পড়া হয় এখানে। তাই দুপুরে ঘুমানোর সময়ও পাওয়া যায় বেশি। রাতে ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময় দশটা থেকে সাড়ে দশটার ভেতর। ফজরের সময় প্রত্যেক মঞ্জিলের নেগরান উস্তাদ এসে জাগিয়ে যান। 

আছরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ফ্রি টাইম। এ সময়টায় মাদরাসার বিশাল মাঠে ছাত্ররা ক্রিকেট, ফুটবল, ভলি বল, ব্যাডমিন্টনসহ নানা খেলায় মেতে ওঠে। কেউ দর্শকের সারিতে বসে খেলা দেখে। মাদরাসার আশপাশের এলাকা পুরোটাই গ্রাম আর খোলা সবুজ মাঠ। কেউবা সবুজের পরশ পেতে বিকেলটা কাটিয়ে দেয় এসব সবুজের মাঠে। মাগরিবের আজানের আগেই মাদরাসায় ফিরতে শুরু করে ইলমের সারথিরা।

প্রতিমাসে এমদাদি ছাত্রদের মাদরাসার পক্ষ থেকে ভাতাস্বরূপ দেওয়া হয় দুশো রুপি করে। মাসের ১৫ তারিখের পর যেকোনো একদিন ভাতা ওঠানো যায়। এছাড়া শীতকালে সকল ছাত্রকে কম্বলও দেওয়া হয়। 

এভাবে নিজস্ব নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে দারুল উলুম দেওবন্দ। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্বের নানা দেশের প্রায় হাজার ছয়েক মুসলিম ছাত্র পড়াশুনো করছেন সেখানে। ভারতের তো বটেই, বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-মালয়েশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ব্রিটেন-আমেরিকা-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও ছাত্ররা শিক্ষা নিতে আসেন এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে।’

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর