বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

রোজা রেখে গান শোনা জায়েজ?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০২২, ০৫:৪২ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

রমজানে গান-বাজনা থেকে মুমিন মুসলমানের দূরে থাকা উচিত। কিছু যদি শোনাই লাগে, তা হবে পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত। এই বিবেচনা-বোধের জন্য দলিলেরও দরকার হয় না। রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক এত গভীর যে, রমজানকে কোরআনের মাস বলেই অভিহিত করা হয়। আর গান-বাজনার কারণে মানুষ কোরআন তেলাওয়াত, কোরআন শ্রবণ, কোরআন খতম, দ্বীনি বৈঠকে অংশগ্রহণ থেকে দূরে থাকে। 

তাই গান শোনা নিয়ে সলফে সালেহিনের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না, বরং ফরজ-ওয়াজিব ইবাদতের পরে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত ও নফল নামাজে সময় পার করতেন তাঁরা। বিশেষ করে রমজানে মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করাকে অপছন্দ করতেন পূর্ববর্তী আলেমে দ্বীনরা। তাঁদের একটি আদর্শ ছিল রমজানে কোরআন খতম করা।


বিজ্ঞাপন


ইব্রাহিম নাখায়ি বলেন, আসওয়াদ রমজানের প্রতি দুই রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। কাতাদা (রহ) স্বাভাবিক দিনে সাতদিনে একবার কোরআন খতম করতেন। কিন্তু রমজান মাস এলে প্রতি তিনদিনে একবার কোরআন খতম করতেন। আর শেষ ১০ রাত শুরু হলে প্রতি রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। মুজাহিদ (রহ) রমজানের প্রতি রাতে কোরআন খতম করতেন। আলী আল-আজদি রমজানের প্রতি রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। রবী বিন সুলাইমান বলেন, শাফেয়ি রমজান মাসে ৬০বার কোরআন খতম করতেন। (আস সিয়ার: ৪/৫১, ৫/২৭৬; আত তিবয়ান, পৃষ্ঠা-৭৪; তাহজিবুল কামাল: ২/৯৮৩)

যদিও প্রতিদিন একবার কোরআন খতম করার বিধান সবার জন্য নয়, এবং সবার জন্য সমীচীনও নয়। ব্যক্তি বিশেষের ভিন্নতার প্রেক্ষিতে এর বিধানও ভিন্ন। (আত তিবয়ান, পৃষ্ঠা-৭৬) 

এই হলো সলফে সালেহিনের অবস্থা। আর আমরা গান-বাজনাকে কেমনে রমজানে জায়েজ করা যায়, সেই চিন্তায় আছি। অথচ রমজান ছাড়াও গান-বাজনা নিয়ে কঠিন কথা বলা আছে ইসলামে। আল্লাহ তাআলা সুরা লুকমানে আখেরাত-প্রত্যাশী মুমিনদের প্রশংসা করার পর দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন—

আর একশ্রেণির লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য। (সুরা লুকমান: ৬)

উক্ত আয়াতের শানে নুজুলে বলা হয়েছে, নজর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কোরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মদ তোমাদেরকে কোরআন শুনিয়ে নামাজ, রোজা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোনো এবং জীবনকে উপভোগ কর। (মাআরিফুল কোরআন: ৭/৪)

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত নাজিল করেন।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদিস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তা হলো গান।’আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একই কথা বলেন। তাবেয়ি সায়িদ ইবনে যুবাইর থেকেও অনুরুপ মত বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ) বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, যা বান্দাকে কোরআন থেকে গাফেল করে দেয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৪৪১)

গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—

তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রাখো, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম। (তিরমিজি: ১২৮২; ইবনে মাজাহ: ২১৬৮)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে, তেমনি গান মানুষের অন্তরে নেফাক সৃষ্টি করে। (ইগাছাতুল লাহফান: ১/১৯৩; তাফসিরে কুরতুবি: ১৪/৫২)

সহিহ বুখারিতে আছে, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে। (সহিহ বুখারি: ৫৫৯০)

বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত নাফে (রহ) থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার চলার পথে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম হ্যাঁ। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না, তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, একদা রাসুলুল্লাহ (স.) চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। (মুসনাদে আহমদ: ৪৫৩৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৯২৪)  বিখ্যাত তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ) থেকেও এমন একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে মাজাহ: ১৯০১)

শুধু গান বাজনা নয়, সাহাবায়ে কেরামগণ বাজনাদার নূপুর ও ঘুঙুরের আওয়াজও সহ্য করতেন না। নাসায়ি ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, একদিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকট বাজনাদার নুপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়েশা (রা.) বললেন, খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন—

যে ঘরে ঘণ্টি থাকে, সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (সুনানে আবু দাউদ: ৪২৩১; সুনানে নাসায়ি: ৫২৩৭) সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হল শয়তানের বাদ্যযন্ত্র। (সহিহ মুসলিম: ২১১৪)

মৃদু আওয়াজের ঘণ্টি-ঘুঙুরের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আধুনিক সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের বিধান কী হবে, তা খুব সহজেই বুঝা যায়। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইমাম মালেক (রহ)-কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে। (কুরতুবি: ১৪/৫৫) ইমাম শাফেয়ী (রহ) বলেছেন, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহম্মক। তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। (ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবি: ১৪/৫৫)

হাম্বলি মাজহাবের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা আলি মারদভি লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরুহে তাহরিমি। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম। (আহসানুল ফতোয়া: ৮/৩৮৮)

ইমাম শাফেয়ী (রহ) শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলিমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলিমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদিসে রয়েছে। (জামে তিরমিজি: ১০৮৯; সহিহ বুখারি: ৫১৪৭, ৫১৬২)

মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হলো বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়। (ফাতহুল বারী: ৯/২২৬)

দফ-এর পরিচয়
দফ-এর এক পাশ খোলা। বাজালে ঢ্যাব ঢ্যাব আওয়াজ হয়। প্লাস্টিকের গামলা বাজালে যেমন আওয়াজ হবে, তেমন। আসলে দফ কোনো বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না। আওনুল বারী গ্রন্থে দফ-এর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে যে, এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফ-এর আওয়াজ যদি চিকন ও আকর্ষণীয় হয়, তখন তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে। (আওনুল বারী: ২/৩৫৭)

আর দফ-এর মধ্যে যখন বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এসে যাবে, তখন তা সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েজ বলে পরিগণিত হবে। (মিরকাত ৬/২১০) 

এখন কেউ যদি বলেন, তৎকালীন যুগে দফ ছিল আরবের সর্বোচ্চ বাদ্যযন্ত্র, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা-ই উন্নত হয়েছে। তাহলে একে অজ্ঞতাপ্রসূত অবাস্তব কথা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। কেননা একাধিক হাদিসে ঢোল, তবলাসহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের নাম এসেছে। কিন্তু মুহাদ্দিসদের ভাষ্য অনুযায়ী, দফ বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না। আরবে এখনো দফ বিদ্যমান আছে।

অনেকে বাদ্যসহ জিকির ও কাওয়ালি জায়েজের দলিল হিসেবে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত দুটি বালিকার দফ বাজিয়ে কবিতা গাওয়ার হাদিসটি উপস্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি রহ. লেখেন, উক্ত হাদিসে আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনাই তাদের অবাস্তব দাবির বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট জবাব। গান-বাদ্য যে নাজায়েজ এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য হাদিসের রাবি হজরত আয়েশা (রা.) বলছেন, উক্ত বালিকাদ্বয় কোনো গায়িকা ছিল না। তারা কোনো গান গায়নি। (ফাতহুল বারি: ২/৪৪২)

ইমাম কুরতুবি (রহ) বলেন, গান বলতে যা বুঝায়, বালিকাদ্বয় তা গায়নি। পাছে কেউ ভুল বুঝতে পারে, তাই আয়েশা (রা.) বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবি আরো বলেন, বর্তমানে একশ্রেণির সুফিরা যে ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটিয়েছে, তা সম্পূর্ণ হারাম। (তাফসিরে কুরতুবি: ১৪/৫৪)

বিখ্যাত সাধক হজরত জুনাইদ বাগদাদি (রহ) তার যুগে কাওয়ালি শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বর্তমানে কাওয়ালি শোনার শর্তগুলো পালন করা হয় না। তাই আমি এর থেকে তওবা করছি। (আহসানুল ফতোয়া: ৮/৩৯২) (সূত্র: আল কাউসার: সংখ্যা-১২)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজা যথাযথ আদায়ের তাওফিক দান করুন। জায়েজ নাজায়েজ প্রশ্নে সন্দেহজনক বিষয়গুলো অন্তত রমজানে এড়িয়ে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন