মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন হবে জাহান্নাামি, একজন হবে জান্নাতি। (সহিহ বুখারি: ৪৭৪১)
এই হাদিসের প্রকৃত অর্থ জানার আগে মূল হাদিসটি একবার দেখে নিই। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন ডাক দিয়ে বলবেন, হে আদম! নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেন যে, আপনি আপনার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামিদের বের করে দিন। আদম (আ.) বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! কতজন জাহান্নামি? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন।... এ বক্তব্য লোকদের জন্য খুবই কঠিন হলো। এমনকি তাদের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন নবী কারিম (স.) বললেন, দেখ ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় থেকে হবে ৯৯৯ জন; আর তোমাদের মধ্য থেকে হবে একজন। তারপর বললেন, মানুষের মধ্য থেকে তোমাদের সংখ্যার তুলনা হবে একটি সাদা গরুর পশমসমূহের মধ্যে একটি কালো পশম অথবা একটি কালো গরুর পশমসমূহের মধ্যে একটি সাদা পশমের মতো। অতঃপর রাসুল (স.) বললেন, ওই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! আমি আশা করি যে, তোমরা জান্নাতিদের এক-চতুর্থাংশ হবে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা এ কথা শুনে ‘আল্লাহ আকবর’ বললাম। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আশা করি তোমরা জান্নাতিদের তিনভাগের একভাগ হবে। আমরা আবারো ‘আল্লাহু আকবর’ বললাম। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আশা করি যে, তোমরা জান্নাতিদের অর্ধেক হবে। তখন আমরা ‘আল্লাহু আকবর’ বললাম। (সহিহ বুখারি: ৪৭৪১; মেশকাত: ৫৫৪১) প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামী
বিজ্ঞাপন
জাহান্নামিদের সংখ্যা নিয়ে আরেকটি মৌলিক হাদিস হলো- আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন; কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আদম (আ.)-কে ডাকা হবে। তিনি তাঁর সন্তানদের দেখতে পাবেন। তখন তাদেরকে বলা হবে, ইনি তোমাদের পিতা আদম। তখন তারা বলবে (আরবি) আমরা আপনার খেদমতে হাজির! এরপর তাঁকে আল্লাহ বলবেন, তোমার জাহান্নামি বংশধরকে বের কর। তখন আদম (আ.) বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! কী পরিমাণ বের করব? আল্লাহ বলবেন- প্রতি একশ’তে নিরানব্বই জনকে বের কর। তখন সহাবিগণ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! প্রতি একশ থেকে নিরানব্বই জনকে বের করা হলে আমাদের কে বাকী থাকবে? তিনি (স.) বললেন; নিশ্চয়ই অন্যান্য সকল উম্মতের তুলনায় আমার উম্মত হলো কাল ষাঁড়ের গায়ে একটি সাদা চুলের মতো। (সহিহ বুখারি: ৬৫২৯) হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামে যাবে
উল্লেখিত দুই হাদিসের একটিতে হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি হওয়ার কথা থাকলেও অন্যটিতে শ’তে ৯৯ জন জাহান্নামি হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে, যা হিসাব করলে হাজারে ৯৯০ জন দাঁড়ায়। আলেমগণ বিভিন্নভাবে দুটি হাদিসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন। যেমন—
১. সংখ্যা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না। বর্ণিত সংখ্যার চেয়েও বেশি হতে পারে। মূলত দুটি সংখ্যা দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে ,মুমিনদের সংখ্যা কম এবং অবিশ্বাসীদের সংখ্যা অনেক বেশি। জাহান্নামীদের সংখ্যা, জান্নাতিদের সংখ্যা
২. আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিসে আদম (আ.)-এর সব বংশধরকেই বোঝানো হতে পারে (ইয়াজুজ-মাজুজসহ)। তাই তাদের মধ্যে যারা জান্নাতে যাবে তারা প্রতি হাজারে একজন হবে। অন্যদিকে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় ছাড়া বাকিদের বোঝানো হতে পারে। তাই তাদের মধ্যে জান্নাতিদের সংখ্যা হাজারে ১০ জন হবে। এই ব্যাখ্যাটির প্রতি সমর্থন এভাবে পাওয়া যায় যে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিসে ইয়াজুজ-মাজুজের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু আবু হুরায়রা (রা.) এর হাদিসে এর উল্লেখ নেই।
৩. এটাও হতে পারে যে, এই ভাগ করার ঘটনা কেবল দুইবারই ঘটবে। একবার ঘটবে যারা এই উম্মতের আগে এসেছিলেন, যখন সংখ্যাটি হবে হাজারে একজন এবং আরেকবার ঘটবে শুধুমাত্র এই উম্মতের সাথে, যখন সংখ্যা হবে হাজারে ১০জন।
৪. “যাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে” এর দ্বারা এটা বুঝানো হতে পারে যে, অবিশ্বাসী এবং পাপী-মুসলিম যারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে, সেখানে কাফেরদের সংখ্যা হবে প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন্য এবং পাপী-মুসলিমদের সংখ্যা হবে প্রতি একশতে নিরানব্বই জন। (দেখুন ফাতহুল বারি: ১১/৩৯০ ইসলামি সওয়াল-জওয়াব ফতোয়া নং: ২২৮৩৬)
বস্তুত জাহান্নামিদের সংখ্যা অনেক বেশি হবে, এতে সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই জিন ও মানুষ দ্বারা জাহান্নামকে পরিপূর্ণ করব’—তোমার প্রতিপালকের এ কথা পূর্ণ হবেই। (সুরা হুদ: ১১৯)
বিজ্ঞাপন
এমনও হাদিস রয়েছে যে, ৭৩টি ফেরকা হবে, তার মধ্যে ৭২টি ফেরকাই জাহান্নামে যাবে। (মেশকাত: ১৭১) এত বেশিসংখ্যক মানুষ জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে পবিত্র কোরআনের এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘..তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না; তাদের রয়েছে চোখ, তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হচ্ছে গাফেল। (সুরা আরাফ: ১৭৯)
সুতরাং বেশি সংখ্যক মানুষ জাহান্নামে যাবে—এটি নিয়ে বিতর্ক নেই। আমরা প্রত্যেকে নিজের চতুর্পাশে ভালো করে তাকালেই তা সহজেই অনুমান করতে পারি। আল্লাহর নাফরমানি চলছে সমাজের সর্বত্র। শুধু মুসলিম সমাজের চিত্রই যদি ভালো করে লক্ষ্য করা হয়, অনুমান করা যায় যে, জাহান্নামিদের সংখ্যা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
সারকথায় যা দাঁড়ায় তা হলো- প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি, এটা মুসলিম-অমুসলিম সবার মধ্য থেকে গণনা হবে। তবে তার মধ্যে উম্মতে মুহাম্মদির সংখ্যা হবে মাত্র একজন। এই একজনের মধ্যে পাপী মুমিনরাও অন্তর্ভুক্ত। পাপী মুমিনরা তাদের গুনাহের কারণে শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর দয়ায় একসময় জান্নাতে যাবে। দুটি হাদিসে দুরকম সংখ্যার বৈপরীত্য দূরীকরণার্থে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, ইয়াজুজ-মাজুজ ও সকল কাফের মুশরিকসহ হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি। আর ইয়াজুজ-মাজুজ ছাড়া অন্যান্য কাফের-মুশরিকের তুলনায় হাজারে ৯৯০ জন জাহান্নামি। (ফায়জুল বারি: ৫/৩৩১)
আল্লাহই অধিক জ্ঞাত