ইয়াজুজ-মাজুজের আত্মপ্রকাশ কেয়ামতের বড় আলামতগুলোর একটি। তারা পৃথিবীজুড়ে রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা চালাবে। মুসলমানরা তখন বিভিন্ন পাহাড়ে ও দুর্গম স্থানে আশ্রয় নেবে। তারপর মুসলমানদের দোয়ায় আল্লাহ তাদের নির্মূল করবেন। ইয়াজুজ ও মাজুজ হচ্ছে হজরত নুহ (আ.)-এর পুত্র ইয়াফেসের বংশোদ্ভূত দুটো সম্প্রদায়। (মুসনাদে আহমদ: ৫/১১)। তাদের আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অবশেষে যখন ইয়াজুজ-মাজুজকে বন্ধনমুক্ত করে দেওয়া হবে এবং তারা উচ্চ ভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে’ (সুরা আম্বিয়া: ৯৬)
ককেশাস ও কোহেকাফ পর্বতমালার আশপাশে তাদের বসবাস ছিল। ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায়ের লুটতরাজ ও অনাচারে সে অঞ্চলের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর তৎকালীন বাদশাহ জুলকারনাইন পৃথিবী সফরে বের হয়ে এমন এক অঞ্চলে পৌঁছেন, যেখানকার বাসিন্দারা ইয়াজুজ-মাজুজের অরাজকতার অভিযোগ করেন। তারা জুলকারনাইনকে এমন একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন, যাতে ইয়াজুজ-মাজুজ ওই প্রাচীর অতিক্রম করে তাদের অঞ্চলে না আসতে পারে। প্রাচীর নির্মাণের যাবতীয় খরচ দেওয়ার জন্যও তারা প্রস্তুত ছিল। বিষয়টি পবিত্র কোরআনে এসেছে এভাবে—
বিজ্ঞাপন
‘অতঃপর জুলকারনাইন পুনরায় পথ চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছলেন, তখন সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল—হে জুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ জমিনে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য খরচ দেব, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিন। তিনি বললেন—আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। তোমরা লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন—তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হলো, তখন তিনি বললেন—গলিত তামা নিয়ে এসো, আমি তা এর ওপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজুজ ও মাজুজ সম্প্রদায় আর সে প্রাচীরের ওপর আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলো না।’ (সুরা কাহাফ: ৯২-৯৭)
সে সময় থেকেই ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় সে স্থানে অবস্থান করছে। কেয়ামতের আগে তারা সে প্রাচীর ভেদ করে পৃথিবীতে বের হয়ে আসবে। যতদিন পর্যন্ত বের হয়ে আসার সময় হবে না, ততদিন তাদের প্রাচীর খোঁড়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রাসুলুল্লাহ (স.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় প্রত্যেকদিন জুলকারনাইনের প্রাচীরটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে প্রাচীরের প্রান্ত সীমার এত কাছাকাছি পৌঁছে যায় যে, অন্য প্রান্তের সূর্যের আলো দেখা যেতে থাকে। তবে তারা এ কথা বলে ফিরে যায়—অবশিষ্ট অংশ আগামীকাল খুঁড়ব। তখন আল্লাহ প্রাচীরটিকে আগের মতোই মজবুত অবস্থায় রূপান্তর করে দেন। পরের দিন এসে তারা প্রাচীর খননে নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করে। যেদিন আল্লাহ তাদের মুক্ত করার ইচ্ছা করবেন, সেদিন তারা খননকাজ শেষে বলবে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা আগামীকাল অবশিষ্ট অংশ খুঁড়ে ওপারে চলে যাব। পরের দিন তারা প্রাচীরের অবশিষ্ট অংশ সেই অবস্থায় পাবে, যতটুকু তারা খুঁড়ে রেখেছিল। অবশেষে প্রাচীর ভেদ করে বের হয়ে পড়বে।’ (তিরমিজি: ৪০৮০, ৩১৫৩; ইবনে মাজা: ৪১৯৯)
ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন ঘটবে দাজ্জাল হত্যার পরে। হজরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করার পর পৃথিবীতে যখন মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসবে ঠিক তখন আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) বলবেন—এখন আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এমন লোকদের বের করব, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি কারও নেই। তাই আপনি মুসলমানদের সমবেত করে তুর পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করুন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজের রাস্তা খুলে দেবেন। তাদের দ্রুত চলার কারণে মনে হবে, যেন ওপরের দিক থেকে বড় পাথর পিছলে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। (মুসলিম: ২৯৩৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ইয়াজুজ-মাজুজ প্রাচীর ভেদ করে পৃথিবীর মানুষের ভেতর বের হয়ে আসবে। আল্লাহ যেমন বলেছেন উঁচু ভূমি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামবে। সমগ্র ভূপৃষ্ঠে তারা ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে দেবে। তাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুসলমানরা গবাদি পশু সঙ্গে করে যার যার শহরে ও দুর্গে আশ্রয় নেবে। ইয়াজুজ-মাজুজ ভূপৃষ্ঠের পানি খেয়ে ফেলবে। তাদের প্রথম দল নদীর পানি এত পরিমাণ নিঃশেষ করবে যে, তা শুকিয়ে যাবে। তাদের পরবর্তী দল সে স্থান অতিক্রম করার সময় বলাবলি করবে, এখানে তো কোনো কালে পানি ছিল না!’ (মুসনাদে আহমদ: ১১৭৩১; কানজুল উম্মাল: ৩৮৬৪৫)
বিজ্ঞাপন
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে তাদের সংখ্যার আধিক্য সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়। হজরত আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে বলবেন, আপনার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামীদের তুলে আনুন। তিনি বলবেন, হে আমার রব! তারা কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামি আর একজন জান্নাতি। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম শিউরে উঠলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন—হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে সে একজন জান্নাতি কে হবে? রাসুল (স.) উত্তরে বললেন, তখন তোমাদের থেকে একজন আর ইয়াজুজ-মাজুজের মধ্য থেকে এক হাজার; এভাবে হিসাব হবে।’ (বুখারি: ৪৭৪১; মুসলিম : ২২২)
এ হাদিস থেকেও বোঝা যায় অসীম, অগণিত হবে তাদের সংখ্যা। তাফসিরবিদ ইবনে কাসির (রহ.) ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে সব বর্ণনা একত্র করে লিখেছেন, ‘এতে বোঝা যায় যে ইয়াজুজ-মাজুজের সংখ্যা সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হবে।’
হুজায়ফা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন। জবাবে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ইয়াজুজ একটি জাতি। মাজুজ একটি জাতি। প্রত্যেক জাতির অধীনে রয়েছে চার হাজার জাতি। তাদের কোনো ব্যক্তি তত দিন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না, যত দিন তারা চোখের সামনে নিজের ঔরসজাত হাজার সন্তান দেখতে না পায়, যাদের প্রত্যেকে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম। হুজায়ফা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে আবেদন জানিয়েছি যেন তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়। তিনি বলেন, তারা তিন ধরনের। তাদের এক দল হবে আরুজের মতো। আরুজ হলো সিরিয়ার একটি বৃক্ষ। এর দৈর্ঘ্য আকাশপানে ১২০ হাত। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, এরা এমন জাতি, কোনো ঘোড়া ও লোহা তাদের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারবে না। আর তাদের অন্য আরেকটি দল এক কানের ওপর ঘুমায় এবং অন্য কান মুড়ি দিয়ে থাকে। তাদের পাশ দিয়ে যত হাতি, বন্য প্রাণী, উট ও শূকর অতিক্রম করে, তারা সেগুলো খেয়ে ফেলে; এমনকি তাদের মধ্য থেকে কেউ মরে গেলেও তারা খেয়ে ফেলে..।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১২৫৭২)
ইয়াজুজ-মাজুজ তাবরিয়া উপসাগর অতিক্রম করে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষদের খুন করতে থাকবে। অতঃপর বাইতুল মোকাদ্দাসের নিকটবর্তী পাহাড় জাবালুল খামারে আরোহণ করে ঘোষণা করবে—আমরা পৃথিবীর অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এখন আকাশের অধিবাসীদের খতম করার পালা। তখন তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর আদেশে সেসব তীর রক্তরঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে। তারা এই ভেবে আনন্দিত হবে যে, আকাশের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে।’ (মুসলিম: ২৯৩৭)
তবে, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, হজ-ওমরা তখনও অব্যাহত থাকবে। এ সম্পর্কে রাসুল (স.) বলেন, ‘ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাবের পরও বায়তুল্লাহর হজ ও ওমরাহ অব্যাহত থাকবে’ (বুখারি: ১৪৯০)। যদিও মুসলমানদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। খাদ্যাভাবে থাকতে হবে। একসময় মুসলমানদের দোয়ার কারণে ইয়াজুজ-মাজুজের বিলুপ্তি ঘটবে।
ঈসা (আ.) ও অন্য মুসলিমরা প্রায় বছরখানেক আবদ্ধ থাকবেন। খাদ্য সংকটের কারণে তখন একটি গরুর মাথার মূল্য ১০০ দিনার স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও বেশি হবে। মুসলমানরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায়ের সবার ঘাড়ে এক প্রকার রোগ ছড়িয়ে দেবেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায়ের সবাই মারা যাবে। অতঃপর ঈসা (আ.) সঙ্গীদের নিয়ে তুর পর্বত থেকে নিচে নেমে এসে দেখবেন পৃথিবীতে তাদের মৃতদেহ থেকে আধা হাত পরিমাণ স্থানও খালি নেই। আর মৃতদেহ পচে অসহ্য দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থা দেখে আবারও ঈসা (আ.) ও মুসলমানরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করবেন। তখন আল্লাহ বিরাটাকার এক প্রকার পাখি প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় হবে উটের ঘাড়ের মতো। তারা মৃতদেহগুলো উঠিয়ে যেখানে আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, সেখানে ফেলে দেবে।’ (মুসলিম: ২৯৩৭)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, ‘সমগ্র পৃথিবীজুড়ে তাদের লাশ থাকবে। আল্লাহ শকুন পাঠাবেন। লাশগুলো তারা নাহবাল নামক স্থানে নিক্ষেপ করবে। মুসলিমরা তাদের তীর ও ধনুক কুড়িয়ে জমিয়ে সাত বছর জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করবে।’ (মেশকাত: ৫৪৭৫)
কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, মৃতদেহগুলো সাগরে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর বৃষ্টি হবে। কোনো নগর ও বন্দর এ বৃষ্টি থেকে বাদ থাকবে না। ফলে গোটা ভূপৃষ্ঠ ধৌত হয়ে কাচের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা ভূপৃষ্ঠকে আদেশ করবেন, তোমার পেটের সমুদয় ফল-ফুল উদগিরণ করে দাও এবং নতুনভাবে তোমার বরকতগুলো প্রকাশ করো। ফলে তা-ই হবে। পৃথিবীতে এমন বরকত প্রকাশিত হবে যে একটি ডালিম এক দল লোকের আহারের জন্য যথেষ্ট হবে। মানুষ তার ফল দ্বারা ছাতা তৈরি করে ছায়া লাভ করবে। দুধে এত বরকত হবে যে একটি উষ্ট্রীর দুধ এক দল মানুষের জন্য এবং একটি গাভির দুধ এক গোত্রের জন্য আর একটি ছাগলের দুধ একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে। ৪০ বছর ধরে এই অসাধারণ বরকত ও শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকবে। এরপর কেয়ামতের সময় সমাগত হবে। আল্লাহ তাআলা একটি মনোরম বায়ু প্রবাহিত করবেন। এর পরশে সব মুসলমানের বগলের নিচে বিশেষ এক ধরনের রোগ দেখা দেবে এবং সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হবে।
শুধু কাফির ও দুষ্ট লোকেরাই অবশিষ্ট থেকে যাবে। তারা ভূপৃষ্ঠে জন্তু-জানোয়ারের মতো খোলাখুলি অপকর্ম করবে। তাদের ওপরই কেয়ামত আসবে। (মাআরেফুল কোরআন)