শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঢাকা–১৪: কথার সৌন্দর্যে নজর কাড়ছেন আরমান–তুলি

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫১ এএম

শেয়ার করুন:

ঢাকা–১৪: কথার সৌন্দর্যে নজর কাড়ছেন আরমান–তুলি
ঢাকা–১৪: কথার সৌন্দর্যে নজর কাড়ছেন আরমান–তুলি
  • ঢাকা–১৪ এ বদলে গেছে রাজনৈতিক ভাবমূর্তি
  • নতুন নেতৃত্বে আশা দেখছেন ভোটাররা
  • বিএনপি ত্যাগ–সংগ্রামকে দিয়েছে অগ্রাধিকার
  • আরমানের শান্ত–দায়িত্বশীল আচরণ প্রশংসিত
  • বাজার–অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন দুই প্রার্থীই

দেশের রাজনীতির দীর্ঘদিনের বিভাজন, হুমকি–ধামকি, হানাহানির ছবিটা যেন ঢাকা–১৪ আসনে এসে বদলে গেছে। হামলা–মামলা, উত্তেজনা বা দোষারোপের বদলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দুই তরুণ প্রার্থী। জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান এবং বিএনপির সানজিদা ইসলাম তুলি। একজন নিজে গুমের শিকার হয়ে ফিরে এসেছেন, আরেকজন গুম হওয়া ভাইয়ের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলনে ছিলেন। প্রতিপক্ষ হয়েও তারা একে অন্যকে সম্বোধন করছেন ‘ভাই’ ও ‘বোন’ বলে। নির্বাচনি প্রচারণায় তাদের কথাবার্তা ও আচরণে রাজনীতির সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। ভোটাররা বলছেন—বিরোধ নয়, উন্নয়ন–নিরাপত্তা আর কাজের রাজনীতিই এবার তাদের চাওয়া।


বিজ্ঞাপন


মিরপুর, গাবতলী, দারুস সালাম, শাহ আলী থানা এবং সাভারের কাউন্দিয়া–বনগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাকা–১৪ আসনের ভোটার সংখ্যা চার লাখের বেশি। এই আসনে এবার মুখোমুখি দুজন ‘ভিকটিম পরিবার’-এর প্রতিনিধি। দুই দলই নিজেদের ভিন্ন কৌশলে মাঠে নামালেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন এই দুই তরুণের মানবিক আচরণ ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থান।

নারী নেতৃত্বের নতুন মুখ তুলি দীর্ঘদিন ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনের গুমের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছেন। এবার প্রথমবারের মতো ধানের শীষ হাতে মাঠে নেমেছেন। বলছেন—অপরাজনীতি নয়, মানবিক রাজনীতির সময় এসেছে। প্রচারণার মিছিলে, পথসভায় ও মতবিনিময়ে তুলির বক্তব্যে প্রতিপক্ষের প্রতি কোনো আক্রমণ নেই; বরং আরমানকে তিনি সম্বোধন করছেন ‘ভাই’ হিসেবে। তুলি বলেন, ‘আরমান ভাইয়ের কথায় আমি সেই ঘ্রাণ পাই, যা গুম হওয়া ভাই সুমনের কাছ থেকে পেতাম।’ তার এই আবেগঘন কথায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।

10

অন্যদিকে জামায়াতের ব্যারিস্টার আরমান নিজেও ছিলেন গুমের শিকার। বাবার মামলায় লড়তে দেশে এসে দীর্ঘ আট বছর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। ৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়ার পর মিরপুরের মাঠে নেমেই পেয়েছেন দলের মনোনয়ন। নির্বাচনি প্রচারে তিনি বলছেন—রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু তা হবে মানুষের কল্যাণে; শত্রুতায় নয়। তিনি তুলিকে ‘বোন’ হিসেবে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘প্রতিযোগিতা থাকবেই, কিন্তু এতে শত্রুতা থাকবে না। এই আসনে আমরা মানবিক রাজনীতির উদাহরণ তৈরি করবো।’


বিজ্ঞাপন


এলাকার ভোটাররাও এই দুই তরুণের আচরণে সন্তুষ্ট। তারা বলছেন, আগে যেখানে উত্তেজনা–বিভক্তি ছিল, এবার সেখানে তৈরি হয়েছে ইতিবাচক পরিবেশ। কাউন্দিয়ার বাসিন্দাদের প্রধান চাওয়া একটি ব্রিজ নির্মাণ— যেটি যোগাযোগব্যবস্থা বদলে যাবে। আরমান–তুলি দুজনেই এই সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ভোটাররা বলছেন, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নয়, কাজের বাস্তব পরিকল্পনা শুনতে চান তারা।

প্রচারণায় তুলির সঙ্গে মাঠে দেখা যাচ্ছে বিএনপির নেতা মাহদি আমিনকে। শোডাউন, লিফলেট বিতরণ এবং এলাকার নারীদের নিয়ে ছোট ছোট বৈঠক করে তুলছেন সমর্থন। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আরমান হুড খোলা গাড়িতে চড়ে বাজার–মসজিদ–অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন। মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্যকেই তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

ঢাকা–১৪ আসনে তৃতীয় কোনো শক্তির উপস্থিতি তেমন নেই। জামায়াত–বিএনপির মধ্যে নিবিড় প্রতিযোগিতায় ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে ভোটারদের কৌতূহল তুঙ্গে। অনেকেই বলছেন, প্রথমবারের মতো দুই গুম পরিবার–সংশ্লিষ্ট তরুণ–তরুণীর মানবিক রাজনীতি বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে নতুন আলো আনতে পারে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তনের যে স্রোত তৈরি হয়েছে, তার প্রতিফলন এই আসনের প্রার্থীদের আচরণেও যেন স্পষ্ট। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আসনটি দেশের অংশগ্রহণমূলক ও নীতিনিষ্ঠ নির্বাচনের রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে। বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে বিএনপি তুলিকে মনোনয়ন দিয়ে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে বলে তারা মনে করেন।

11

দিনের পর দিন প্রচারণা শেষে সন্ধ্যায় এলাকার চায়ের দোকানে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—আরমান–তুলির ‘ভাই–বোন’ সম্পর্ক এবং তাদের সুশীল আচরণ। মিরপুর–২–এর বাসিন্দা মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা চাই, এমন মানুষ রাজনীতিতে আসুক যারা শত্রুতা নয়, দায়িত্ব বুঝে কাজ করবে। আরমান–তুলি দুজনই সেই জায়গায় অন্যরকম।’

কল্যাণপুরের সাব্বির রহমান বলেন, ‘কে জিতবে বলা কঠিন, তবে মনোনয়নে দুই দলই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত এবার একটা ভিন্ন বার্তা দিয়েছে—গুম হওয়া পরিবারের পাশে থাকা, মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থ বা প্রভাব নয়, গুরুত্ব পেয়েছে ত্যাগ, সংগ্রাম আর জনসম্পৃক্ততা। নেতৃত্বের নির্দেশনায় যিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছেন, নিপীড়িত পরিবারের পাশে থেকেছেন, তিনি–ই দলের কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।

নেতাকর্মীরা বলেন, আসন্ন নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ ও আন্দোলনের আদর্শের পরীক্ষাও বটে। তারা বলছে, যারা জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন ও সংগঠনের বড় দায়িত্বে যুক্ত আছেন, তাদের পক্ষে স্থানীয়ভাবে সার্বক্ষণিক প্রচারণা চালানো সবসময় সম্ভব হয় না। তাই কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেউ কেউ নির্বাচনে না নেমে দলের বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়নে মনোযোগ দিচ্ছেন—এটিকে তারা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।

নেতাকর্মীদের দাবি, ঢাকা–১৪ আসনে যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তিনি সংগ্রামী ব্যাকগ্রাউন্ড, জনযোগ্যতা, যোগ্যতা ও মানবিকতার প্রতীক। তার জন্য কাজ করা মানে দলের আদর্শকে শক্তিশালী করা, নিপীড়িত মানুষের পক্ষের অবস্থানকে মূল্যায়ন করা। দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রেখে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমেছেন, সংগঠন তাদের মূল্যায়ন করবে বলেও তারা জানান।

14

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ও দলীয় মুখপাত্র ড. মাহদী আমিন বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও নীতিনির্ধারকরা সমর্থন জানিয়েছেন—গুম হয়ে আজও ফিরে না আসা বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন, ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক ও মানবাধিকারকর্মী তুলি সেই প্রার্থী, যিনি নেতার নির্দেশনায় জনগণের পাশে থাকবেন। আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত, তরুণ এই নেত্রীর আন্তরিকতায় স্পষ্ট, তিনি নেতাকর্মীদের ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন, ঐক্য ধরে রাখবেন এবং এলাকার উন্নয়নে ব্রত থাকবেন।

মাহদী আমিন বলেন, সানজিদা ইসলাম তুলির জন্য কাজ করা মানে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত থাকা, ধানের শীষে মিশে থাকা, আদর্শকে ধারণ করা, নিপীড়িত মানুষের আবেগকে সম্মান জানানো।

জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বলছেন, ব্যারিস্টার আরমানকে ঘিরে দলীয় পর্যায়ে একটি নতুন ধরনের আস্থা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ নির্যাতন, গুমের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তিনি যে শান্ত, দৃঢ় ও দায়িত্বশীলভাবে সামনে এসেছেন, তা তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

নেতাকর্মীরা আরও বলছেন, আরমানের ফিরে আসা জামায়াতের জন্য মানসিক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাকে দেখছে একজন সাহসী, শিক্ষিত এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ার মতো সক্ষম মানুষ হিসেবে। তার আইনজ্ঞান, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই তাকে দলের ভিন্নধারার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে তুলে ধরেছে। আরমানকে সামনে রেখে সংগঠন আরও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং এটি প্রমাণ করছে— নিপীড়ন বা দমন-পীড়ন দিয়ে আদর্শ দমন করা যায় না।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার–মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ঢাকা–১৪ আসনের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান যে শালীনতা, ধৈর্য ও মানবিক আচরণের উদাহরণ দেখিয়েছেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, দীর্ঘ নির্যাতন ও গুমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরও আরমান যেভাবে শান্ত ও দায়িত্বশীলভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা প্রমাণ করে— আদর্শকে দমন করা যায় না।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় এই নেতা বলেন, তরুণ প্রজন্ম আজ মানবিক, নীতিনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দেখতে চায়, আরমান ঠিক সেই ধারার প্রতীক এ কারণে জামায়াতে ইসলামী তাকে সেখানে মনোনীত করেছে। এলাকার সাধারণ মানুষও তার আচরণ ও বক্তব্যে আশাবাদী হয়েছে। জুবায়ের বলেন, ব্যারিস্টার আরমান প্রমাণ করেছেন যে, রাজনীতি মানে উত্তেজনা নয়—নৈতিকতা, সৌজন্য ও জনগণের সমস্যা সমাধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা। তার এই দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা সংগঠনের জন্য শক্তি হিসেবে কাজ করছে। আরমান ঢাকা–১৪ আসন মানবিক রাজনীতির নতুন উদাহরণ হয়ে উঠবে, যেখানে উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও জনকল্যাণই হবে প্রতিযোগিতার প্রধান ভিত্তি।

এএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর