টানা তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়ার হাতছানি। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে না আসায় আওয়ামী লীগের আবার ক্ষমতায় ফেরা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে বিরোধীদের বর্জনের নির্বাচন যেন দেশে-বিদেশে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পায় সেটাই এখন ক্ষমতাসীনদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এতে মাঠ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা আমেজ ইতোমধ্যে চলে এসেছে। প্রায় অর্ধেক আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বতন্ত্র বা অন্য দলের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অনেক আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা এবং বিরোধী শিবিরের ভোট ঠেকানোর আন্দোলন ও প্রচারণার মুখে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই এখন আওয়ামী লীগের সামনে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
একজন ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে যে প্রতীকেই ভোট দিক, কেন্দ্রে যেন যান সেটা নিশ্চিত করতে ‘গো ভোট’ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে যেন আশানুরূপ ভোটার উপস্থিত হয় সেই লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। সেখানে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে।
ভোট পড়ার হার বাড়াতে পারলে দেশে-বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেখানো যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যেকটি নির্বাচনী কেন্দ্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের প্রার্থীদের বলা হয়েছে, টার্গেট রাখতে হবে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে ৫৬ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির। যদি সম্ভব না হয়, কমপক্ষে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
২০১৪ সালের নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আওয়ামী লীগের সামনে। সেই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় দেশে-বিদেশে সমালোচনা হয়েছে। তবে এবার আগেভাগে কৌশল নেওয়ায় একটি আসনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন থাকেনি। তবে অনেক আসনে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় এবারও ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল। বিশেষ করে রাজধানীর ঢাকার আসনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এখানে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এক্ষেত্রে দলীয় সমর্থকও অনেক সময় ভোট দিতে আসেন না।
ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রে শক্তিশালী কমিটি করা হচ্ছে। এসব কমিটি ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের সবধরনের নাশকতার প্রচেষ্টা প্রতিহত করবে। প্রতিটি কমিটিতে সদস্য থাকবেন ন্যূনতম ৩০০ জন। এভাবে সারাদেশে মোট ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের জন্য কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এসব কমিটিতে কাজ করবেন আওয়ামী লীগের প্রায় দেড় কোটি নেতাকর্মী। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবে। শুধু নৌকা প্রতীকের পক্ষেই ভোটারদের আনা হবে তা নয়, সেখানে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে যদি বোঝা যায় কোনো ভোটার ওই প্রার্থীর সমর্থক তাহলে তাকেও ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য উৎসাহিত করা হবে।
এছাড়াও দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগও ইতোমধ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানো এবং যারা নির্বাচনের উৎসব নষ্ট করার চেষ্টা করবে, তাদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সারা দেশে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য ২০ সদস্যের করে কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব কমিটিতে প্রায় সাড়ে আট লাখ সদস্য থাকবে বলে জানিয়েছে সূত্র। এছাড়া অওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য পৃথক কামিটি গঠন করে আওয়ামী লীগের মূল কমিটির সঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে গ্রাম থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। যারা দলের ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে আছেন তাদের নেতৃত্বে কমিটি করা হচ্ছে। এর বাইরেও লোকজন রাখা হচ্ছে। কোনো ভোটারকেই তালিকার বাইরে রাখা হবে না। আর প্রত্যেক ভোটারকেই ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার লোক থাকবে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার এই কৌশলকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘গো ভোট’ ক্যাম্পেইন নাম দেওয়া হয়েছে।
তবে শহরাঞ্চল, বিশেষ করে ঢাকা শহরের আসনগুলোতে ভোটার কতটা উপস্থিত হবেন সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে আওয়ামী লীগে। ফলে রাজধানীতে বাড়তি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকার নিম্নবিত্ত ভোটারদের তালিকা করে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। ভোটার লিস্ট ডিজিটাল করা এবং প্রত্যেক ভোটারকে তার ভোটার নাম্বার ও কেন্দ্র জানিয়ে মোবাইল ফোনে মেসেজ দেওয়া। আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার জোরদার করা। এই ভোটারদের মধ্যে আবার যারা সরকারি নানা সহায়তা প্রকল্পের সুবিধাভোগী তাদের নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। তাদের ওপর আলাদা নজর থাকবে ক্ষমতাসীন দলের।
এবারের ভোটে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নাও আসতে পারে এটা ধরে নিয়ে অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী ছক সাজাতে থাকে আওয়ামী লীগ। গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠকে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন বিষয়ে নির্দেশনা দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আহ্বান জানাতে হবে ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য। কেন্দ্রে ভোটার আনতে কাজ করতে হবে। ভোটার টানতে যত কৌশল বা কর্মসূচি প্রয়োজন তা নিতে হবে।’
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, বিএনপির নির্বাচনবিরোধী অপতৎপরতার পরও নির্বাচন জমে উঠেছে। ভোটাররা উৎসবের আমেজে ভোট দিতে যাবেন। আর নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা দেখবেন।
তবে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমি আমেরিকায় ছিলাম। সেখানে অনেক নির্বাচন দেখেছি। আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক ও শিক্ষিত সমাজে ৪০ শতাংশ ভোটও কাস্ট হয় না। সেখানে আমাদের মতো দেশে সব মানুষ ভোট দিতে আসবে এমটা আশা করতে পারি না।
জেবি