স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না থাকায় অনেকে এই পদ ছেড়ে ভোটে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে অন্তত ৪১ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া দুইজন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং একজন সদস্যও রয়েছেন। এই তালিকায় আছেন বেশ কয়েকজন পৌরসভা চেয়ারম্যানও।
ইতোমধ্যে তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং পদ শূন্য ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগকারীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভোটে লড়তে যারা পদ ছেড়েছেন
সূত্র জানায়, ঢাকা বিভাগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়েছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মো. ইউনুস ইসলাম তালুকদার ও মির্জাপুরের মীর এনায়েত হোসেন মন্টু, ঢাকার ধামরাইয়ের মো. মোহাদ্দেছ হোসেন, কিশোরগঞ্জের কমিরগঞ্জের মো. নাসিরুল ইসলাম খান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মো. শাহজাহান ভূঁইয়া, রাজবাড়ী সদরের মো. ইমদাদুল হক বিশ্বাস, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মুশফিকুর রহমান খান, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের মহিউদ্দিন আহমেদ এবং নরসিংদীর মনোহরদীর মো. সাইফুল ইসলাম খান বীরু।
রাজশাহী বিভাগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শফিকুল ইসলাম ও বেলকুচির মো. নুরুল ইসলাম (সাজেদুল), বগুড়ার শেরপুরের মজিবর রহমান মজনু ও আদমদীঘির মো. সিরাজুল ইসলাম খান রাজু এবং পাবনার চাটমোহরের মো. আব্দুল হামিদ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগে নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মো. আব্দুল হাই আকন্দ ও ঈশ্বরগঞ্জের মাহ্মুদ হাসান সুমন, শেরপুরের শ্রীবরদীর এ ডি এম শহিদুল ইসলাম ও ঝিনাইগাতীর এস এম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম পদত্যাগ করেছেন।
সিলেট বিভাগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার এ কে এম সফি আহমদ (সলমান) পদত্যাগ করেছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ডের এস এম আল মামুন, সাতকানিয়ার আব্দুল মোতালেব, পটিয়ার মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও চন্দনাইশের মোহাম্মদ আবদুল জব্বার চৌধুরী; চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ও হাজীগঞ্জের গাজী মাঈনুদ্দিন, কুমিল্লার দেবিদ্বারের মো. আবুল কালাম আজাদ ও চৌদ্দগ্রামের আবদুস ছোবহান ভূঁইয়া, কক্সবাজারের মহেশখালীর মোহাম্মদ শরীফ বাদশা ও রামুর সোহেল সরওয়ার কাজল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ফিরোজুর রহমান পদত্যাগ করেছেন।
আরও পড়ুন
এছাড়া খুলনা বিভাগে মেহেরপুর সদরের মো. ইয়ারুল ইসলাম, সাতক্ষীরা সদরের মো. আসাদুজ্জামান বাবু ও শ্যামনগরের এস এম আতাউল হক এবং কুষ্টিয়ার মিরপুরের মো. কামারুল আরেফিন উপজেলা উপজেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
রংপুর বিভাগে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন সরকার, নীলফামারীর সৈয়দপুরের মো. মোখছেদুল মোমিন, গাইবান্ধা সদরে শাহ সারোয়ার কবীর উপজেলা পরিষদের পদ ছেড়ে দিয়েছেন।
বরিশাল বিভাগে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শামসুল আলমও পদত্যাগের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
এছাড়া, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাফর আলী ও মো. মতিয়ার রহমান পদত্যাগ করেছেন। যশোর জেলা পরিষদের সদস্য মো. আজিজুল ইসলামও পদ ছেড়ে দিয়েছেন।
কেন এই পদত্যাগের হিড়িক
প্রতিবারই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ পদত্যাগ করে থাকেন। তবে এবারের মতো এত ব্যাপকভাবে আগে কখনো পদত্যাগ করেননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ হিসেবে বলছেন, যারা পদত্যাগ করছেন তাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। তাদের অনেকেই নৌকার মনোনয়ন পেতে ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন।
এবার এই প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ার আরেকটি কারণও আছে। অন্য নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি থাকে। তবে এবার এখনো সেটা নেই। এমনকি এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকলে প্রার্থী হওয়ার কথা বলা হয়েছে দলের সর্বোচ্চ মহল থেকে। গত রোববার গণভবন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কেউ নিজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় বিজয়ী হতে পারলে সেই সুযোগ আছে। মূলত দলীয় প্রধানের এই ঘোষণার পরই আওয়ামী লীগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়েছে। এজন্য অনেকেই স্থানীয় সরকারের পদ ছেড়ে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে শামিল হচ্ছেন।
আরও পড়ুন
শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে না সেটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ এই কৌশল অবলম্বন করেছে। এবার যেন কোনো আসনে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে না পারেন সে ব্যাপারে শেখ হাসিনা নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এ কারণেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন।
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোকছেদুল মোমিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পদত্যাগ করছেন। তিনি সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের মসজিদ ও মাদরাসার উন্নয়ন, কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা, অসুস্থদের চিকিৎসা ও দায়গ্রস্ত কন্যাদের বিয়ের পাশাপাশি সব বিষয়েই সাহায্য ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি। বাকি জীবন জনগণের সেবা করেই মরতে চাই।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করা জাকির হোসেন সরকার বলেন, পদত্যাগ করেছি। মিঠাপুকুরের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও মিঠাপুকুরের আপামর জনসাধারণের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধন্ত গ্রহণ করা হবে।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করা জান্নাতুল ফেরদৌস আরা ঝুমা তালুকদার বলেন, ‘কর্মী-সমর্থকরা আশায় ছিলেন। তারা বলছেন নির্বাচন করতে। যেহেতু নেত্রীও বলে দিয়েছেন স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে দলের কোনো বাধা নেই, তাই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে যে সম্মানী ভাতা পেয়েছি, তা সবটুকু প্রতিমাসেই সাধারণ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি। আমার বাবার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করতে চাই। দুর্গাপুর-কলমাকান্দার অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।
জেবি